ক্রীতদাসের হাসি: সরকারের বিরুদ্ধে উপন্যাস লিখে সেই সরকারের থেকেই পুরস্কার পাওয়া শওকত ওসমান

Emadul Mubin
By -
0

শওকত ওসমান

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অন্যতম যুগান্তকারী অগ্রনায়ক শওকত ওসমান। উপন্যাস ও গল্প রচয়িতা হিসেবেই তার মুখ্য পরিচয়। তাকে বলা হয় ‘জাতির কথাশিল্পী’। তবে তিনি নিজেকে ‘ঝাড়ুদার’ বলে পরিচয় দিতেন। আসলেই তো ঝাড়ুদার তিনি, সমাজের ঝাড়ুদার। সমাজের সব জঞ্জাল, অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার সাক্ষী ও অংশীদার ছিলেন। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে একজন সচেতন জীবনবাদী মানুষ হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করেছেন।

শওকত ওসমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

শওকত ওসমান ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ আজিজুর রহমান; ‘শওকত ওসমান’ তাঁর সাহিত্যিক নাম। তিনি কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসা ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। এছাড়া শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম কলেজ অব কমার্স এবং ঢাকা কলেজে। ১৯৭২ সালে অধ্যাপনা থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান।

Shawkat Osman
                                   স্ত্রীর সঙ্গে শওকত ওসমান। ছবি: জাঁ-নেসার ওসমানের সৌজন্যে

তাঁর জননী (১৯৫৮) ও ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬২) উপন্যাস দুটি সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে। জননীতে সামাজিক জীবন ও ক্রীতদাসের হাসিতে রাজনৈতিক জীবনের কিছু অন্ধকার দিক উন্মোচিত হয়েছে। উপন্যাস ও গল্প রচনার জন্য পরিচিত হলেও তিনি প্রবন্ধ, নাটক, রম্যরচনা, স্মৃতিকথা ও শিশুতোষ গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। বিদেশি ভাষার অনেক উপন্যাস,  ছোটগল্প ও নাটক তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন।

ক্রীতদাসের হাসি

ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটি একটি রূপকধর্মী উপন্যাস। এর কাহিনী নেয়া হয়েছে আরব্য রজনী আলিফ লায়লা ও লায়লা এর গল্প নেওয়া হয়েছে"জাহাকুল আবদ" থেকে। উপন্যাসিক মূলত রূপকভাবে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন এবং পূর্ব বাংলার মানুষের অবস্থা তুলে ধরেছেন। কিন্তু মজার কথা হলো, এই ব্যাঙ্গাত্মক রূপক উপন্যাসের জন্যই তৎকালীন সরকার তাকে ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার  প্রদান করে।

যদিও উপন্যাসটিতে অনেক ঐতিহাসিক চরিত্র আছে, কিন্তু ইতিহাসের সাথে এর মিল নেই। এছাড়া, এই উপন্যাসটি খুব বেশি সংলাপ নির্ভর। তাই এটি নাটক না উপন্যাস তা নিয়ে বেশ খটকা লাগে। বাংলা সাহিত্যে এরকম না-উপন্যাস না-নাটক রূপের উপস্থাপন এর আগে দেখা যায়নি। এছাড়াও, এই উপন্যাসে আরবি ফারসি শব্দের বাহুল্য রয়েছে। তবে যেহেতু বাগদাদের কাহিনী বর্ণনা করা হচ্ছে তাই এই ব্যাপারটি কাহিনীকে আরও জীবন্ত করেছে।

চরিত্রসমূহ

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলো হলো, খলিফা হারুনুর রশিদ, হাবশী দাস তাতারী। এছাড়া, আর্মেনীয় দাসী মেহেরজান, খলিফার স্ত্রী জুবায়দা, খলিফার সহচর মশরুর, নর্তকী বুসায়না, জল্লাদ, উজিরে আজম জাফর বার্মাকী উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র।

উপন্যাসের মূল ঘটনা

উপন্যাসের মূল ঘটনা শুরু হয় হাবশী গোলাম তাতারী ও আর্মেনীয় দাসী মেহেরজানের প্রণয়ের মাধ্যমে। খলিফার স্ত্রী জুবায়দার অনুমতিতে তাদের বিয়ে হয় এবং প্রতিরাতে তারা মহলের নির্দিষ্ট এককোণে দেখা করতো। এসব কিছুই হচ্ছিল খলিফার অজান্তে। ঠিক একই সময়ে উজিরে আজম জাফর বার্মা কি হত্যার আদেশ কার্যকর হওয়ার পর খলিফা হারুনুর রশিদ চরম মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। তার সহচর মশরুর তাকে খোলা উদ্যানে নির্মল পরিবেশে হাঁটাহাঁটির পরামর্শ দেন।

পরামর্শ মোতাবেক খলিফা যখন রাজমহলের উদ্যানে পায়চারি করছিলেন তখন তিনি উচ্ছ্বসিত একযুগল মানব মানবীর হাসির আওয়াজ শুনতে পান। খলিফা এমন হাসির আওয়াজ সহ্য করতে পারেননি। হাসির কারণ অনুসন্ধানে খলিফার সামনে তাতারী ও মেহেরজানের প্রণয়ের কথা প্রকাশ পায়। খলিফা দেখলেন তার কাছে এত বৈভব থাকার পরও তিনি তাদের মতো হাসি হাসতে পারছেন না। কিন্তু, তাদের তো কিছুই নেই তারপরও তারা এত স্বচ্ছন্দে আছে কিভাবে!

খলিফা তাতারী ও মেহেরজানকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। তাদেরকে বিশাল রাজ্যের অধিপতি করা হয়। অন্যদিকে মেহেরজানকে খলিফার স্ত্রীতে পরিণত করা হয়। প্রিয়ার শোকে হতবিহ্বল তাতারীকে খলিফা আগের মত হাসতে বলেন। কিন্তু তাতারী আর হাসে না। বাগদাদের সবচেয়ে আবেদনময়ী নর্তকী বুসায়ানাকে তাতারীর সামনে আনা হয়, তাতেও কোন লাভ হয় না। বরং বুসায়ানা তাতারীর সঙ্গ পেয়ে উল্টো নাচগান ছেড়ে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে খলিফা তাতারি কে চাবুক মারার নির্দেশ দেয়। তাতারী তারপরেও নিশ্চুপ থাকে। খলিফার এই অত্যাচার দেখে প্রতিবাদ করে রাজ দরবারের কবি আবু নুয়াস। খলিফা কবিকে বহিষ্কার করে।

সর্বশেষ উপায় হিসেবে তাতারীর সামনে মেহেরজানকে ফেরত আনা হয়। কিন্তু এতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না। কারণ তাতারী মেহেরজানকে বলে, তুমি তো আমার প্রিয়া নও বরং খলিফার রানী। তখন চরম ক্ষোভে খলিফা তাকে কোড়া চাবুক মারার নির্দেশ দেন। তখন তাতারী খলিফাকে বলে,

শোনো, হারুনুর রশিদ! দিরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে, বান্দি কেনা সম্ভব-! কিন্তু, কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি না-না-না-না!

এ উক্তিটি উপন্যাসের জীবনদর্শন। এর দ্বারা বোঝা যায় স্বাধীনতার চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। একমাত্র স্বাধীনতাই পারে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।

রূপকাশ্রয়ে রাজনৈতিক সমালোচনা 

বাক স্বাধীনতা যখন চরমভাবে রুদ্ধ হয় তখন সাহিত্যিকদের কলম হয়ে ওঠে প্রতিবাদের প্রধানতম কণ্ঠস্বর। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে আইয়ুব খান। তার আমলের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল নজরকাড়া মেকি উন্নয়ন। দেশব্যাপী বড় বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু, আদতে সে মৌলিক গনতন্ত্রের নামে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল, বাক স্বাধীনতার হরণ ছিল তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার জন্য আইয়ুব খান ঘোষণা করেছিল উন্নয়নের দশক। কিন্তু স্বাধীনতা যেখানে রুদ্ধ মানুষ উন্নয়ন দিয়ে কি করবে!

স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে উন্নয়নের ছড়ি ঘোরানো আইয়ুব খানের সমালোচনায় শওকত ওসমান ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসটি রচনা করেন। সেখানে হারুনুর রশিদ হলেন আইয়ুব খান আর তাতারী হলো বাংলার জনগণ। তাতারী নিজের প্রিয়তমাকে নিয়ে স্বচ্ছন্দে ছিল। যদিও তার অঢেল সম্পদ ছিল না, কিন্তু ছিল মনের স্বাধীনতা। কিন্তু, হারুনুর রশীদ তার সেই মনের প্রশান্তিকে ছিনিয়ে নেয়, তবে তার বদৌলতে অঢেল সম্পদ, রাজত্ব কিংবা আবেদনময়ী নর্তকী তাকে প্রদান করা হলে সেই সেই সুখ স্বাচ্ছন্দ ও হাসি ভরা মুখ আর ফিরে আসে না।

বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার স্বাধীনতা চায়। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের ফলে দেশের বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিদূরিত হয়। উন্নয়নের যতই রং তামাশা দেখা যাক না কেন ঐ সময়ে দেশের জনগণ ছিল অত্যাচারিত। সরকারের ক্ষুদ্রতম অপরাধকে সমালোচনা করলে গুরুদন্ড দেওয়া হতো। ফলে জনগণের জীবন ছিল অতিষ্ঠ। তাই উন্নয়নের ঘনঘটা মানুষের মনে আনন্দের উদ্রেক ঘটাতে পারেনি। উপন্যাসিক শওকত ওসমান এই জিনিসটাই রূপকার্থে উপস্থাপন করেছেন।

শেষকথা

সময় ও রূপক-ফ্যান্টাসির শিল্পকে ধারণ করে 'ক্রীতদাসের হাসি' বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। উপন্যাসটি মূলত বাংলাদেশের ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতার শিল্পিত রূপ। আর এ বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার জন্যই আঙ্গিক কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছেন রূপক এবং কাহিনির আদল হিসেবে কল্পনা করেছেন আরব্য উপন্যাসের আদল। উদ্দেশ্য শাসকদের বিভ্রান্ত করা। এক্ষেত্রে তিনি সফলও হয়েছিলেন। তখনকার শাসকগণ এ উপন্যাসের রূপকী ব্যঞ্জনা অনুধাবন না করেই এ উপন্যাসের জন্যই তাকে 'আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৬)' প্রদান করেছিল।


তথ্যসূত্রসমূহ

১. শওকত ওসমান - বাংলাপিডিয়া

২. জাতির কথাশিল্পী শওকত ওসমান

৩. ক্রীতদাসের হাসি, শীকর গ্রন্থ সমালোচনা, মোহসীনা নাজিলা, পৃ: ২৫২-২৫৫.

Tags:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)