![]() |
সিডনি শনবার্গ (১৯৩৪-২০১৬); |
সিডনি শনবার্গ (Sydney Schanberg) ১৯৩৪ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের হারবার্ট বিশ্ববিদ্যালয় পড়া এই সাংবাদিক ১৯৫৯ সালে দি নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় যোগদান করেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভীতিকর সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। এমনকি তিনি তার অভিজ্ঞতা প্রসূত বইয়ের মাধ্যমে পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছেন।
![]() |
বঙ্গবন্ধুর সাথে সিডনি শনবার্গ, ১৯৭২; Photo Source: www.beyondthekillingfields.com |
মুক্তিযুদ্ধের সময় সিডনি শনবার্গ
১৯৭০ সালে, সিডনি নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭০ সালে যখন ভয়াবহ সাইক্লোন বাংলাদেশের উপকূলকে ধ্বংসাবশেষে পরিণত করেছিল, তখন তিনি ঐ অঞ্চলের মানুষের দুঃখ কষ্ট সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছাড়া, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ভয়াবহ দিনগুলোতে তিনি একনিষ্ঠভাবে নিজের সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
২৫ মার্চ কাল রাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন তখন তিনি ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন। যদিও পাকিস্তানি বাহিনী ওই হোটেলে থাকা বিদেশিদেরকে বাইরে বের হতে দেয়নি, তিনি তার হোটেলের ছাদ ও জানলা দিয়ে ওই কালো রাতের হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। ২৭ মার্চ শনিবার সকালে বিশেষ বিমানে করে তাকে করাচি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। করাচি থেকে বোম্বেতে গিয়ে উপস্থিত হন সিডনি। সেখান থেকে তিনি তার প্রথম রিপোর্ট পাঠান।
![]() |
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা, ১৯৭১; Image Source: Prothom Alo |
ঐ রিপোর্টে হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে উল্লেখ করেন, সেনাসদস্যরা যখন গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ১৫ থেকে ২০ জন বাঙালি যুবক প্রায় ২০০ গজ দূরে তাদের মুখোমুখি হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু মনে হল তারা নিরস্ত্র, খালি হাত। জিপের উপরের মেশিনগান ঘুরিয়ে ধরল তাদের দিকে, এরপর চলল গুলি। স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী সৈন্যরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিলো। যুবকেরা রাস্তায় দুই পাশে ছড়িয়ে পড়ল, কেউ নিহত কিংবা আহত হয়েছে কিনা তা বোঝা অসম্ভব ছিল।”
সিডনি ভারতে গিয়ে বসে থাকেন নি বরং ভারতে প্রবেশ করা বাংলাদেশী শরণার্থীদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি শুরু করেন। ২১ মে “ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের দুর্দশা” শিরোনামে রিপোর্টে বলা হয়, “পূর্ব পাকিস্তান ঘিরে ভারতের ১৩৫০ মাইল দীর্ঘ সীমান্তের চেহারা দাঁড়িয়েছে এক অন্তহীন ও চরম দুর্দশা গ্রস্থ জিপসি ক্যাম্পের মত। পাক বাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভীত ও হতবিহবল মানুষের বিরাট ঢেউ- ভারত বলছে এই সংখ্যা তিন মিলিয়ন ছাড়িয়েছে। সেনাবাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভারতে আসছে।” এছাড়া জনগণার্থীদের দুর্দশা নিয়ে তিনি আরো বেশ কিছু রিপোর্ট করেছিলেন।
সিডনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুন মাসে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিলেন। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চাচ্ছিল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের মাধ্যমে সংবাদ করিয়ে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে। কিন্তু ঘটনা আসলে বেশিদূর গড়িয়ে গিয়েছিল। সিডনি সেই সেই সব বিভীষিকার সংবাদ প্রকাশ করা শুরু করেন ফলে তাকে আবার দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। অবশেষে তিনি ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সাথে যশোর সীমান্ত হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। তিনি বাংলাদেশের বিজয়ের সাক্ষী ছিলেন।
সিডনি ১৯৭১ সালের পুরো নয় মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঘটা বিভীষিকা আন্তর্জাতিক মহলে প্রকাশ করেন। নিউইয়র্ক টাইমসে পাঠানো মুক্তিযুদ্ধের উপর অসংখ্য খন্ড খন্ড প্রতিবেদনের মধ্য থেকে ৩৬ টি প্রতিবেদন নিয়ে ১৯৯৫ সালের 'ডেট লাইন বাংলাদেশ: নাইন সেভেন্টিওয়ান' শিরোনামে বই প্রকাশ করা হয়।
শেষকথা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও বিশ্বব্যাপী অন্যান্য সংঘাত সিডনিকে আকর্ষিত করেছে। তাই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরে কম্বোডিয়া যান। কম্বোডিয়ার খেমাররুজ শাসনামলে গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহের সময় সহযোগী ডিথ প্রাণ গেরিলাদের হাতে বন্দী হন এবং অলৌকিকভাবে বেঁচে আসেন। এ ঘটনা নিয়ে শনবার্গ 'দ্য ডেথ এ্যান্ড লাইফ অব ডিথ প্রাণ' শিরোনামে একটি বই লিখেন। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত এ বই নিয়ে পরবর্তীতে 'দ্য কিলিং ফিল্ডস' সিনেমা হয় এবং সিনেমাটি অস্কার পুরস্কার লাভ করে। ফলে সিডনি শনবার্গ সারা বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে উঠেন।
![]() |
কম্বোডিয়ায় খেমারুজ সৈন্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় সিডনি শনবার্গ; Image Source: The New York Times. |
'ডেট লাইন বাংলাদেশ: নাইন্টি সেভেন্টিওয়ান' বইয়ের অনুবাদক মুফিদুল হক বলেন- কম্বোডিয়ায় কাজের জন্য শনবার্গ অনেক প্রশংসা পেয়েছেন, পুলিৎজ্জার পুরষ্কার পেয়েছেন। তার কাজ নিয়ে সিনেমা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নৃশংসতা নিয়ে তিনি যে প্রশংসনীয় কাজ করেছেন সে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে বিস্মৃত অধ্যায় হয়ে গেছে। এখানে কোনো পুলিৎজার পুরস্কার নেই কিংবা বৈশ্বিক দর্শকদের জন্য কোনো সিনেমাও হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো সিডনি শনবার্গকে ভুলতে পারবে না। তিনি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের অংশ এবং যতদিন ইতিহাস থাকবে ততদিন তিনি জীবিত থাকবেন।
২০১২ ও ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার 'মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধু'দের সম্মাননা জানায়। সম্মাননা গ্রহণের জন্য শনবার্গকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু হার্টে অস্ত্রপাচারের কারণে তিনি আসতে পারেন নি। শনবার্গ ৯ জুলাই ২০১৬ নিউইয়র্কের পগকিপসি শহরে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু তাকে কেড়ে নিলেও তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের সঙ্গে, ইতিহাসের পাতায়।
References:
1. Remembering Sydney Schanberg.
2. শীকর গ্রন্থ সমালোচনা, মোহসীনা নাজিলা।