১৩৫০ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলা সাহিত্যের এক ধারাবাহিক ইতিহাস বিদ্যমান এবং তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ অপ্রতুল। এমনকি ঐ সময়টাতে এই সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষতা লাভ করেছে। কিন্তু ধোঁয়াশার জায়গা ঠিক এর পূর্ববর্তী দেড় শত বছর নিয়ে। অর্থাৎ বাংলায় মুসলমানদের আগমনের পর থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত। এখন আদৌও কি ঐ যুগ অন্ধকার যুগ ছিল কিনা এ নিয়েও মতভেদ করার সুযোগ আছে!
অন্ধকার যুগের ব্যাপ্তি
১২০১-১৩৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা তুর্কি শাসন চলছিল। আর এই সময়টাকে অনেক পণ্ডিত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন।
অন্ধকার যুগের পক্ষে
সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগকে মুসলিম আগমনের হেতু সৃষ্টি হয়েছে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে মুসলমানদের আক্রমণ ও লুটতরাজের ফলে বাংলার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সাহিত্য চর্চা প্রতিকূলে চলে যায়। এমনকি অনেক সাহিত্যিক ও পণ্ডিত নেপালে পলায়ন করে। তার মতে এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন নেপালের রাজ দরবারে পাওয়া গেছে।
এছাড়া, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই না পাওয়ার উপর ভিত্তি করে বলছেন- ”এই সময়ে সাহিত্যচর্চা নামমাত্র ছিল। বস্তুত মুসলমান অধিকারকাল হইতে এই সময় পর্যন্ত কোনো বাংলা সাহিত্য আমাদের হস্তগত হয় নাই। আমরা এই ১২০১ হইতে ১৩৫২ পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বা সন্ধিযুগ বলিতে পারি।”
![]() |
শিল্পীর তুলিতে বাংলা বিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি; Image Source: alaponblog.com |
ব্যতিক্রমী হুমায়ুন আজাদ
অন্যদিকে, হুমায়ুন আজাদ তার বিখ্যাত লাল নীল দীপাবলি গ্রন্থে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল এই সময়টাকে বাংলা সাহিত্যের কৃষ্ণগহ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে মুসলিম আগমনের কারণে বাংলা সাহিত্যের ভাটা পড়েছিল তিনি এটা মানতে নারাজ। তার মতে তখন সাহিত্য চর্চা হয়েছিল কিন্তু যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে তা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। কারণ মধ্যযুগীয় মুসলিম শাসকবর্গ বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির নিমিত্তে বেশ বদান্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাহলে তারা কেন বাংলা সাহিত্য চর্চায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া, মানুষ তখন মুখে মুখে সাহিত্য চর্চা করতো। ফলে কেউ ভুলে যাওয়ার অর্থ সাহিত্যকর্ম একেবারে হারিয়ে যাওয়া।
তবে, অন্ধকার যুগ সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের এক ব্যতিক্রমী মত আছে। তার মতে, যেহেতু চর্যাপদ বাংলা কি এ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে, তাই চর্যাপদকে যদি বাংলা ভাষার সাথে সম্পৃক্ত করা না হয়। তাহলে, অন্ধকার যুগের কোনো আলোচনা করার প্রয়োজন নেই। কারণ, চর্যাপদ রচিত হয়েছে ৯৫০ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে। আর, অন্ধকার যুগের ব্যপ্তি বাদ দিয়ে আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে যদি ১৩৫০ সাল থেকে শুরু করি তাহলে অন্ধকার যুগ আলোচনায় আসবে না। এটা নিয়ে বিতর্ক থাকবে না!
![]() |
রাজশাহী কলেজ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দূর্লভ চর্যাপদ এর অংশবিশেষ; Image Source: Wikipedia. |
পাল্টা যুক্তি
কিন্তু এই যুগটিকে অন্ধকার বলে বাদ দিয়ে দেওয়া মোটেই যৌক্তিক নয়। বরং অনেক গবেষক এই যুগে একাধিক গ্রন্থ ও রচনা আছে বলে মত দিয়েছেন।
যেমন অধ্যাপক মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের শুরুতেই ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত সময়কে তথাকথিত 'অন্ধকার যুগ' বলে একটি বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। মধ্যযুগের সাহিত্যের অস্পষ্ট আঙিনায় যথোপযুক্ত আলোকপাত না করেই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের প্রতি যথার্থ মর্যাদা না দেওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিতর্কের ধূম্রজাল সৃষ্টি করার উদ্যোগ এতে লক্ষ করা যায়। গবেষণা কর্মের মাধ্যমে নিত্য নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে সাহিত্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অনেক অবকাশ এখনও রয়েছে। অথচ তা না করে তথাকথিত অন্ধকার যুগ আখ্যা দিয়ে মূল্যবান অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা চলছে।"
এ প্রসঙ্গে আমরা ড. এনামুল হকের মন্তব্য স্মরণ করতে পারি, “এ সময়ে মানুষ তাহার সুখ-দুঃখের কোনো গান কিংবা গাথা নিজস্ব একেবারেই প্রকাশ করে নাই, এমন হইতেই পারে না।” তিনি আরও বলেন, ”বাংলা সাহিত্যের তুর্কিযুগ প্রধানত ভাষা গঠনের কাল। বাঙালির মন এ সময়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে নদীর ধারার মতো এঁকে-বেঁকে। নিজের পথ নিজের ভাষার খাতে কেটে চলেছে।”
ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ গ্রন্থে লিখেছেন- “বাংলা সাহিত্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা, শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিল্প-সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।” তবে তার মতে বাংলা ভাষা চর্চায় এক ধরনের বন্ধ্যত্ব দেখা গিয়েছিল তবে তো মুসলিম শাসকদের জন্য নয়, বরং তিনি বলেন, ”প্রথমে সেন ও পরে পাঠান আমলে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পটভূমি পরিবর্তিত হলে সহজিয়া সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি ঘটে। ফলে তাদের ধর্মসাধনা ও জ্ঞানসাধনা রুদ্ধ হয়; সেই সাথে বাংলা সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, কেননা ঐ যুগে সহজিয়াগণই বাংলা ভাষার একমাত্র ধারক ও বাহক ছিলেন।”
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে সর্বপ্রথম গভীর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনাকারী দীনেশ চন্দ্র সেনের বক্তব্য যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাবো বাংলা ভাষার বর্তমান বিকাশিত রূপ ধারণে মুসলিম শাসকরা কি পরিমান অবদান রেখেছেন। যেখানে ব্রাহ্মণরা বাংলা চর্চাকে হীন কাজ মনে করতেন এবং বাংলা ভাষা পৌরাণিক গ্রন্থাদি অনুবাদকে পাপ মনে করতো, সেখানে মুসলিম শাসকবর্গ রামায়ণ ও মহাভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করান। তাঁরা যদি বিধর্মী বিদ্বেষী হতেন তাহলে কখনোই ঐ সকল গ্রন্থ অনুবাদে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন না। মুসলমান শাসকগণ বাংলা সাহিত্যকে যে দুর্দিন থেকে উদ্ধার করেন, সেটার গুরুত্ব বিবেচনা করেই ড. দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেছিলেন,
“আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয়ই বঙ্গ ভাষারই সৌভাগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
অন্ধকার যুগের সাহিত্যকর্মসমূহ
১. 'প্রাকৃতপৈঙ্গল'
এটি ত্রয়োদশ শতকে প্রাকৃত ভাষায় শ্রীহর্ষ রচিত গীতিকবিতার মহাসঙ্কলন যা অন্ধকার যুগের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন।
২. 'শূন্যপুরাণ'
রামাই পণ্ডিত রচিত ধর্ম পূজার শাস্ত্রগ্রন্থ। এটি ৫১টি অধ্যায় সম্বলিত সংস্কৃত ভাষায় গদ্য পদ্য মিশ্রিত চম্পুকাব্য। এর মূল নাম পাওয়া যায়নি, তাই নগেন্দ্রনাথ বসু এর নাম রাখেন 'শূন্যপুরাণ'। এতে শূন্যময় দেবতা ধর্মঠাকুরের পুজা পদ্ধতির বর্ণনা আছে বলেই এর নাম রাখা হয় 'শূন্যপুরাণ'। এ গ্রন্থের অন্তর্গত 'নিরঞ্জনের রুম্মা' বা 'নিরঞ্জনের উম্মা' কবিতায় ব্রাহ্মণ্য শাসনের বদলে মুসলিম শাসন প্রচলনের পক্ষে মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে।
৩. 'সেক শুভোদয়া'
রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র সংস্কৃত ভাষায় গদ্য পদ্যে (চম্পুকাব্য) ২৫টি অধ্যায়ে এটি রচনা করেন। শেখের শুভোদয় অর্থাৎ শেখের গৌরব প্রচারই এর মূল উপজীব্য। এ গ্রন্থে মুসলমান দরবেশের চরিত্র ও আধ্যাত্ম্যিক শক্তির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, যা বাংলা ভাষায় রচিত পীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক কাব্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।
৪. ডাক ও খনার বচন
‘ডাক’ বলতে বোঝায় ‘প্রচলিত বাক্য’, আর খনা বলতে একজন ব্যক্তিবিশেষকে। খনা ছিলেন একজন বিদুষী নারী, যাকে একজন বাঙালি কবি মনে করা হয়। বাঙালি কবি খনার জীবনকাল ছিল ৮০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। মূলত খনা কর্তৃক কথিত মূল্যবান বচনসমূহই খনার বচন নামে পরিচিত।
১) কলা রুয়ে না কাট পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।
২) কার্তিকের ঊন জলে,
খনা বলে দুনো ফলে।
৩)জৈষ্ঠ্যে শুকো আষাঢ়ে ধারা
শস্যের ভার না সহে ধরা।
শেষকথা
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের ব্যাপ্তি ছিল ৬৫০-১২০০ সাল এবং এই সময়ে একটিমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় তা হলো চর্যাপদ। অন্যদিকে, তথাকথিত অন্ধকার যুগ তথা তুর্কি শাসনামলে প্রাকৃতপৈঙ্গল, শূন্যপুরাণ ও সেক শুভদয়ার মতো গ্রন্থ পাওয়া গেছে। তাহলে অনেক পণ্ডিত কিভাবে প্রাচীন যুগকে অন্ধকার যুগ না বলে তুর্কি যুগকে অন্ধকার যুগ বলেন। কারণ, সাহিত্যিক নিদর্শন এর সংখ্যার উপর ভিত্তি করে যদি কোন যুগে কোন যুগ অন্ধকার কিনা তা নির্ধারণ করা হয় তাহলে তুর্কি যুগ অন্ধকার যুগ নয়।
তথ্যসূত্রসমূহ
১. লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, হুমায়ুন আজাদ, সর্বশেষ সংস্করণ: জুলাই, ২০২৪।
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, মাহবুবুল আলম, সর্বশেষ সংস্করণ: মার্চ, ২০২৪।
৩. History of Bengali Literature, Sukumar Sen, 1971.
৪. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অন্ধকার যুগ কি আসলেই ছিল? - রোর বাংলা।
ফিচার ইমেজ: chharpatra.com