বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। ২০০৬ সালে এই ফুটবল খেলার মাধ্যমে আইভেরি কোস্টের স্ট্রাইকার দিদিয়ে দ্রগবা নিজের দেশের গৃহ যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন খেলাধুলার মাধ্যমে যে দেশের মানুষ এক হয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে, সে দেশে গৃহযুদ্ধ কেন বিভাজন সৃষ্টি করবে। খেলাধুলার মাধ্যমে যুদ্ধের প্রতিরোধ ইতিহাস প্রথম নয়। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসে অলিম্পিক খেলার আয়োজন করা হতো যুদ্ধের বদলে খেলাধুলার মাধ্যমে জয় পরাজয় নির্ধারণের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও এমন খেলাধুলার ইতিহাস রয়েছে। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। তবে এই দল যুদ্ধ বন্ধ করেনি ঠিকই। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন জানি বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক ফুটবল দল সম্পর্কে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল দল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত অর্জন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করতো। পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল এটি। এই দলের মূল পরিকল্পনাটা ছিল শামসুল হকের। তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসের কলকাতায় বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ক্রীড়া সমিতি থেকেই গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। যাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সারা ভারতজুড়ে ফুটবল খেলার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতির পক্ষে সমর্থন আদায় এবং অর্থ সংগ্রহ করা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। আর সহ অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। কোচ ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন যথাক্রমে ননী বসাক ও তানভির মাযহারুল তান্না। ক্রীড়া সমিতি ম্যাচ খেলা থেকে অর্জিত ৫ লাখ ভারতীয় রুপি মুক্তিযোদ্ধা ফান্ডে জমা দিয়েছিল।
জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের ব্যাপারে তাগাদা দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন। এরপর তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার বেতার যোগে ঘোষণা সকল ফুটবলারদের ভারতে আসতে। এভাবেই গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
প্রথম ম্যাচ
১৯৭১ সালের জুন মাসে গঠিত হওয়া স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তখন থেকেই অনুশীলন শুরু করে। অবশেষে জুলাই মাসের ২৫ তারিখ প্রথম ম্যাচের তারিখ ঘোষিত হয়। নদীয়া জেলায় কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে কৃষ্ণনগর একাদশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামে। দলের ম্যানেজার তানভির মাযহারুল তান্না ঐ দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, "উত্তেজনার মাত্রা মারাত্মক উঁচুতে ছিল। খেলোয়াড়দের তো আরও বেশি ছিল। ২০ হাজার লোক হাজির। এরকম বিশাল সংখ্যক দর্শক আসবে, ভাবতে পারিনি। কোনো একটা জায়গা খালি ছিল না।" স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতের মাটিতে ১৭ টি ম্যাচ খেলেছিল। খেলার জয়পরাজয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যগণ
জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শঙ্কর হাজরা (সহ-অধিনায়ক), আলী ইমাম, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, আইনুল হক, নিহার কান্তি দাস, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, শাহজাহান আলম, মনসুর আলী লালু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, সুভাষ সাহা, কে এম নওশেরুজ্জামান, ফজলে সাদাইন খোকন, আবুল হাকিম, তসলিমউদ্দিন শেখ, আমিনুল ইসলাম, আবদুল মমিন জোয়ারদার, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, সাত্তার, প্রাণ গোবিন্দ কুন্ডু, মুজিবর রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) খন্দকার নুরুন্নবী, লুৎফর রহমান, সাইদুর রহমান প্যাটেল, অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি, সনজিব কুমার দে, মাহমাদুর রশিদ, দেওয়ান মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন, নিহার কান্তি দাস।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ এই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল। তারা নিজেদের জায়গা থেকে এ দেশকে স্বাধীন করার চেষ্টা করেছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল তারই একটি উদাহরণ।