ইউরোপীয়রা আমেরিকা মহাদেশদ্বয় আবিষ্কার করে সবার আগে ১৫৯২ সালে কলম্বাসের শাপে বর প্রাপ্তির মাধ্যমে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার হয় আরো পরে ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুকের মাধ্যমে। তবে আমেরিকা মহাদেশদ্বয় আমাদের আলোচনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঐ মহাদেশদ্বয়ে ইউরোপীয়রা সোনার ফসল ফলানো উর্বর মাটির সন্ধান পায়। এমন মাটির দৃষ্টান্ত গোটা ইউরোপেই অপ্রতুল। কিন্তু উর্বর মাটিতে ফসল একা একা ফলবে না বরং এর জন্য প্রয়োজন কৃষকদের। যাঁদের হাড় ভাঙা পরিশ্রমে মাটিতে সোনা ফলে।
![]() |
ক্রিস্টোফার কলম্বাস জ. ১৫৫১ |
তখন ইউরোপীয়দের হাতে শ্রম যোগান দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি উপায় ছিল। প্রথমত, ইউরোপ থেকে চাষীদের নিয়ে আসা, দ্বিতীয়ত, স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে চুক্তি করে তাদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা এবং সর্বশেষটি, যে উপায়কে তারা শ্রম যোগানের জন্য বাছাই করে নেয় তা হলো, আফ্রিকা থেকে দাসদের নিয়ে এসে তাদের কৃষি শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা। এই সর্বশেষ উপায়টি ছিল সবচেয়ে লাভজনক। কারণ দাসদের শ্রমের মূল্য নেই; তাদের শ্রমের একমাত্র মূল্য তাদের জীবন।
আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ দাসদের ঐ মহাদেশদ্বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শ্রমিক হিসেবে। আফ্রিকা থেকে দাস সংগ্রহের প্রধান পদ্ধতি ছিল যুদ্ধ ও দাস ক্রয়। ইউরোপীয় কখনো কখনো কোনো কোনো আফ্রিকান গোত্রের সাথে যুদ্ধ করে ঐ গোত্রের সকলকে দাসত্ব বন্দী করতো। আবার কখনো কখনো অভ্যন্তরীণ কোনো দাস ব্যবসায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে দাস সংগ্রহ করে ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রি করতো। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়া ঐ দাসদের কেউ কেউ যাত্রা পথেই মারা পড়তো। যারা সেই ভয়ানক সমুদ্র যাত্রা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতো তাদের ভাগ্যে থাকতো যুগ যুগান্তরের গ্লানি। ঐ দাসদের অধিকাংশ কাজ করতো কৃষি কর্মে। কৃষিতে উৎপাদিত প্রধান পণ্য ছিল তামাক। আর এই তামাক থেকেই সামনে আসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নাম।
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মাদক সাম্রাজ্য ছিল ব্রিটিশদের। তারা বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে তামাক উৎপাদনের স্বর্গরাজ্যে রূপান্তর করে ছিল। আফ্রিকা থেকে আনা দাসদের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে উৎপাদিত তামাক তারা সারা বিশ্বেব্যাপী বিক্রি করতো। আর সাধারণত তামাক সেবনকারীরা একবার শুরু করলে আর জীবনেও শেষ করতে পারে না। মাদক ব্যবসায়ীরা সেই বিষয়টি ভালোভাবেই বোঝে। কিন্তু আবার পর্যাপ্ত উৎপাদন না থাকলে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা পরিচালনা অসম্ভব। তামাকের সেই ক্রমাগত স্থির উৎপাদন নিশ্চিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। আর সেই উৎপাদন করেছে পারিশ্রমিক বিহীন কালো দাসরা।
![]() |
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি |
কিন্তু সকল বিত্তশালী বিশাল জ্ঞানী হয় না। সেই হিসেবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনকারী ইউরোপীয়রা জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এছাড়া গত দুই তিন শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা যে মাত্রায় উন্নতি অগ্রগতির সাক্ষাৎ পেয়েছে সেটা শুধুমাত্র মধ্যসত্ত্বভোগীতার মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। বরং এর জন্য প্রয়োজন দূরদর্শিতা ও অধ্যবসায়। অর্থাৎ তারা সম্পদ আহরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং সেই সম্পদের উপযোগিতার যথাযথ ব্যবহার করেছে।
আধুনিক সময়ে আমরা দেখি কৃষক ফসল উৎপাদন করে এবং তারা যে দামে বিক্রি করে তার চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় বা তার চেয়ে বেশি দামে শহরের ক্রেতারা ক্রয় করে। মাঝখান দিয়ে পণ্য সংরক্ষণ ও পরিবহনের নামে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের। এটা তো গেল কৃষি পণ্যের কথা। সরকারি বেসরকারি সেবা গ্রহণ করতে গেলে দালাল মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে দালাল মধ্যস্বত্বভোগীরা সরাসরি কর্মকর্তাদের সাথে সিন্ডিকেট করে নানা ধরনের দুর্নীতি করে।
এখন আমরা যদি বৈশ্বিক পরিমণ্ডল বিবেচনা করি, তখনও দেখতে পারবো মধ্যস্বত্বভোগীদের জয়জয়কার যদিও তারা সবসময় এক রূপে থাকে না। ইউরোপীয়রা এখনও সেই প্রভাবশালী মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে দাড়িয়ে আছে। পৃথিবীর কোনো ব্যবসা তাদের মাধ্যম ও হস্তক্ষেপ ছাড়া সংঘটিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। ডলার অর্থনীতি এর একটি বড় প্রমাণ। যখন চীন নিজের গায়ের জোরে নিজস্ব অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করতে চেয়েছে, তখন চীনের বিরুদ্ধে ঠিকই বানিজ্য যুদ্ধ ঘোষিত হয়।
মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশরা ভালোভাবেই রপ্ত করেছিল। এখন সেই জায়গায় আছে যুক্তরাষ্ট্র; যদিও যুক্তরাষ্ট্র নব্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু, এই যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে লক্ষ লক্ষ দাসের রক্ত ও ঘামের মাধ্যমে। যেই রক্ত ও ঘামের মূল্য কিভাবে পরিশোধ করা সম্ভব তা কে জানে!