ড. ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব: টেঁকসই উন্নয়নের রূপকল্প

Emadul Mubin
By -
0

A World of Three Zeros' by Dr Muhammad Yunus

অর্থনৈতিক মুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনের উপায় হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার করে ড. মুহাম্মদ ইউনুস যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছেন। এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু, আধুনিক যুগে মানবজাতি যেমন বিভিন্ন সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনি নানাবিধ আধুনিক সমস্যায় নিমজ্জিত হচ্ছে। তন্মধ্যে প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিতকরণ ও সমাধানকল্পে ড. ইউনূসের ”A World of Three Zeros: The New Economics of Zero Poverty, Zero Unemployment, and Zero Net Carbon Emissions” গ্রন্থটি রচনা করেছেন।


Nobel Laureate Dr Muhammad Yunus
নোবেল পুরস্কার হাতে ডঃ ইউনুস, 

২০১৭ সালে প্রকাশিত ড. ইউনুসের “A World of Three Zeros” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তিনি এই গ্রন্থে এক সাহসী ধারণা উপস্থাপন করেছেন, তিনি যার নাম দিয়েছেন “Three Zeros” তথা তিন শূন্য থিয়োরি, যা হলো Zero Poverty, Zero Unemployment, এবং Zero Net Carbon Emissions অর্থাৎ তিনি এখানে তিনটি শূন্য অর্জন করা: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, এবং শূন্য নেট কার্বন নির্গমন। এই ধারণা বাস্তবায়িত হলে ড. ইউনুসকে আবারও নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে দেখা যেতে পারে। কারণ, এই থিয়োরির মধ্যে আমাদের বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলির সমাধান নিহিত রয়েছে।

পুঁজিবাদের ব্যর্থতা

ড. ইউনূস তার বই শুরু করেছেন পুঁজিবাদের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে। লেখক বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা দিয়ে বইটি শুরু করেন। তিনি দেখান যে কীভাবে এই ব্যবস্থা সম্পদের এককেন্দ্রিকতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে পৃথিবীর সম্পদের অধিকাংশ মাত্র কয়েকজন ধনী ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। এই ব্যবস্থা কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্যই তৈরি করে না, এটি গণতন্ত্র এবং সামাজিক সংহতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সামাজিক ব্যবসা:

ড. ইউনুসের প্রস্তাবিত সমাধানের মূল ভিত্তি হলো সামাজিক ব্যবসা। প্রথাগত ব্যবসা যেখানে মুনাফাকে অগ্রাধিকার দেয়, সেখানে সামাজিক ব্যবসার লক্ষ্য হলো সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধান করা। সামাজিক ব্যবসা হলো এমন একটি "নন-ডিভিডেন্ড কোম্পানি" যার উদ্দেশ্য মানবিক সমস্যার সমাধান করা এবং যেখানে লাভ পুনরায় ব্যবসায় পুনঃ বিনিয়োগ করা হয়।

তিন শূন্য তত্ত্ব:

১.  Zero Poverty: শূন্য দারিদ্র্য 

ড. ইউনুসের তিন শূন্য তত্ত্বের প্রথম লক্ষ্য হল Zero Poverty, অর্থাৎ দারিদ্র্যের সম্পূর্ণ অবসান। যদিও ইতিমধ্যে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনে যুগান্তকারী রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন, তবুও তিনি চান সেই রূপরেখার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য শূন্যতে নেমে আসুক। তিনি বিশ্বাস করেন যে দারিদ্র্য কেবল অর্থনৈতিক সমস্যার ফল নয়, বরং এটি একটি সামাজিক সমস্যা যা সঠিকভাবে সমাধান করা সম্ভব। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রবর্তন করে ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন যে এই পদ্ধতি কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য মুক্ত করা সম্ভব।

২.  Zero Unemployment: শূন্য বেকারত্ব

তিন শূন্য তত্ত্বের দ্বিতীয় লক্ষ্য হল Zero Unemployment, অর্থাৎ বেকারত্বের সম্পূর্ণ অবসান। ড. ইউনুস বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেক মানুষের কর্মসংস্থান একটি মৌলিক অধিকার। তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন যে মানুষ কেবল চাকরি খোঁজার জন্য জন্মায় না। বরং, তিনি মনে করেন যে প্রত্যেকের মধ্যেই উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। আর, এটা সম্ভব করতে সামাজিক ব্যবসার মডেলগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এই মডেলগুলো লাভের পরিবর্তে মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হয়, যা কর্মসংস্থান তৈরি করতে সহায়ক। তিনি বিশ্বাস করেন, সামাজিক ব্যবসা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং মানুষকে তাদের দক্ষতা ও প্রতিভা কাজে লাগাতে সহায়তা করতে পারে।

৩.  Zero Net Carbon Emissions: শূন্য কার্বন নিঃসরণ

তিন শূন্য তত্ত্বের তৃতীয় ও সর্বশেষ লক্ষ্য হল Zero Net Carbon Emissions, অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণকে সম্পূর্ণভাবে শূন্যে নামিয়ে আনা। আধুনিক শিল্পযুগের একটি বড় সমস্যা হলো কার্বন নিঃসরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে আমাদের গ্রহকে রক্ষা করতে হলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস একটি জরুরি পদক্ষেপ। ড. ইউনুস ব্যবসায়িক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে টেকসইতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে সামাজিক ব্যবসা পরিবেশবান্ধব পণ্য ও প্রক্রিয়া তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক হতে পারে।


বিশ্ব পরিবর্তনের মেগাপাওয়ারস:

ইউনুস তিনটি প্রধান "মেগাপাওয়ারস" নির্ধারণ করেছেন, যা তিনটি শূন্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ:

১. তরুণ প্রজন্ম:

তরুণদের শক্তি, সৃজনশীলতা, এবং আদর্শবাদ পরিবর্তন আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউনুস তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের আহ্বান জানান।

২. প্রযুক্তি:

প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বিশ্বের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। ইউনুস প্রযুক্তির শক্তিকে মুনাফার পরিবর্তে সামাজিক মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।

৩. সুশাসন ও মানবাধিকার:

ইউনুস বিশ্বাস করেন যে একটি ন্যায্য এবং সমতামূলক সমাজ গঠনের জন্য সুশাসন ও মানবাধিকার অপরিহার্য। তিনি সামাজিক ব্যবসাকে সহায়তা করার জন্য আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের আহ্বান জানান।


ড. ইউনুস ইতিমধ্যে তাঁর মাইক্রোক্রেডিট ধারণার জন্য বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছেন, এবং তিনি দেখিয়েছেন যে একজন ব্যক্তি কীভাবে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর “A World of Three Zeros” বইয়ে প্রস্তাবিত Three Zeros থিয়োরি, যা দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং কার্বন নিঃসরণের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান প্রদান করে, নোবেল পুরস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী প্রার্থীতা হতে পারে। এই থিয়োরি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী একটি টেকসই, ন্যায়সংগত, এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব।

ড. ইউনুসের Three Zeros থিয়োরি আমাদের সময়ের জন্য একটি প্রয়োজনীয় সমাধান হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদি এটি বৈশ্বিকভাবে গৃহীত এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এটি তাকে আরও একবার নোবেল পুরস্কারের সম্মান এনে দিতে পারে। তাঁর এই সাহসী এবং প্রয়োজনীয় ধারণা বিশ্বকে একটি নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে সকলের জন্য সমান সুযোগ, দারিদ্র্যমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব পৃথিবী সম্ভব হবে।

ড. ইউনুস তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তি কতটা প্রভাব ফেলতে পারেন। তাঁর “A World of Three Zeros” বইয়ে উল্লিখিত Three Zeros থিয়োরি শুধুমাত্র একটি ধারণা নয়; এটি একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা যা আমাদের ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করতে পারে। এই থিয়োরির জন্য তাঁর নোবেল পুরস্কারের যোগ্যতা নিঃসন্দেহে প্রাপ্য, এবং আমরা আশা করি যে বিশ্ব এটি গ্রহণ করবে এবং এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য একসাথে কাজ করবে।

Key Themes: #Dr._Muhammad_Yunus #Sustainable_Development #Three_Zeros #ড. মুহাম্মদ ইউনূস #টেকসই_উন্নয়ন #তিন_শূন্য

Tags:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)