হামাস: মুক্তিকামী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক

Emadul Mubin
By -
0

Hamas

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিপক্ষে সকল ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার জলন্ত প্রদীপ হামাস। এই রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠনটির মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে গভীর আদর্শিক‌ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৮৭ সালের প্রথম ইনতিফাদার (الانتفاضة) সময় এর জন্ম। এই সংগঠনটির প্রধান উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনকে মুক্ত করা পূর্বক ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হওয়া নাগরিকদের দেশে ফেরত আনা। যদিও গাজা উপত্যকা ব্যতীত হামাসের উপস্থিতি তেমন কোথাও নেই, তবুও স্বপ্ন দেখতে দোষ কি!
Hamas

উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠা

হামাস (حماس) শব্দের অর্থ উদ্যম, উদ্দীপনা। তবে বিশ্বব্যাপী হামাস নামে পরিচিতি লাভ করলেও এই সংগঠনটির আসল নাম হারকাতুল মুকাওয়ামা আল ইসলামিয়া (حركة المقاومة الإسلامية) অর্থাৎ ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষভাগে এই ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন তথা হামাসের প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয়। যা প্রায় দশ বছর ধরে চলে। অবশেষে, ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর, প্রথম ইন্তিফাদার সময়, গাজা উপত্যকায় শেখ আহমেদ ইয়াসিনের (أحمد ياسين) বাড়িতে ইসলামী আন্দোলনের বেশ কয়েকজন নেতা মিলিত হন। সেখানেই ইসরাইল দখলদারিত্বের বিপক্ষে পাথর নিক্ষেপ ও বিক্ষোভ মিছিল করার মাধ্যমে প্রতিরোধ জানানোর কার্যক্রম হাতে নিয়ে হামাস গঠিত হয়।

Shaikh Ahmad Yasin was killed on 22 March 2004
শেখ আহমদ ইয়াসিনকে ২০০৪ সালের ২২ মার্চ হত্যা করা হয়।

ঐ বৈঠকে হামাসের প্রথম বিবৃতি খসড়া করা হয়। সেই বিবৃতি মুদ্রণ ও প্রচার কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন তরুণ বিপ্লবী ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৪ ডিসেম্বর গাজা উপত্যকা ব্যাপী সেই বিবৃতির মুদ্রিত রূপ বিলি করা হয়। ফিলিস্তিনি মুক্তি কামে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাহক ছিল সেই বিবৃতিটি। পরবর্তী কার্যক্রম হিসেবে হামাস ১৯৮৮ সালে তার প্রথম সনদ জারি করে এবং ১৯৯১ সালের আগস্টে তার প্রথম শুরা কাউন্সিল গঠন করে।

আন্দোলনের উত্থানের কারণ 

দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা ফিলিস্তিনি জনগণের উপরে অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের উত্থান ঘটেছিল, বিশেষ করে, ১৯৪৮ সালের নাকবা (نكبة) থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। মূলত, হামাস প্রতিষ্ঠার পিছনে নানাবিধ একইসাথে নানাবিধ অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক কারণ রয়েছে।

Nakba 1948
নাকবা শব্দের অর্থ বিপর্যয়; ছবিতে ১৯৪৮ সালে বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিদের বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে।

অভ্যন্তরীণ কারণ হিসেবে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ধারাবাহিকতা এবং এর নিত্যনৈমিত্তিক উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এই আন্দোলনের উত্থানের পিছনে প্রধান উদ্দীপকের ভূমিকা পালন করেছে। আর আঞ্চলিক পর্যায়ে ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইলের মধ্যে ঘটা ##ছয় দিনের যুদ্ধে আরব সামরিক শক্তিগুলোর পরাজয়ের পর থেকে অন্যান্য আরব দেশগুলো ফিলিস্তিন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের সীমানায় মনোনিবেশ করে। তখন ফিলিস্তিনবাসী বুঝতে পারে তাদের লড়াই তাদের লড়তে হবে। সেই সূত্র ধরেই হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও এর জন্য আশির দশকের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন নামকরণ

হামাস মূলত মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিন তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা। অর্থাৎ হামাস প্রতিষ্ঠার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইখওয়ান ইসলামী আন্দোলনের জন্য কর্মতৎপরতা চালায়, হামাসও একইভাবে ইসলামী আন্দোলনকে মূলভিত্তি হিসেবে ধরে। একইসাথে তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ইসরাইলের দখলদারিত্বের প্রতিকার করা। এই কারণে হামাসের মূল নাম হারকাতুল মুকাওয়ামা আল ইসলামিয়া (حركة المقاومة الإسلامية) অর্থাৎ ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন।

Hamas Logo
হামাসের লোগো

চিন্তা ও আদর্শ

হামাসের চিন্তা ও আদর্শ ইখওয়ানুল মুসলিমিন থেকে গৃহীত। যদিও ইসরাইলের অনবরত অত্যাচারের বর্ষণ সেই চিন্তা ও আদর্শে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে বটে। কিন্তু, দিনশেষে হামাস ইসলামী নীতি নৈতিকতার কঠোর অনুশীলন করে। ইখওয়ানুল মুসলিমিন ও হামাসের আন্দোলনের একটা বড় পার্থক্য হলো হামাসের আন্দোলন জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। বর্তমানের পৃথিবীতে যখন মানবাধিকারের সমারোহে প্লাবিত, তখন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নির্যাতিত হওয়া ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কেউ কিছু করে না।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘদিন হামাস প্রচলিত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে দূরে ছিল। কিন্তু ২০০৫ তারা ফিলিস্তিনের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং গাজা উপত্যকায় জয় যুক্ত হয়। এটা ছিল ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল ফাত্তাহর জন্য বড় ধাক্কা। অন্যদিকে, ইসলামী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হামাসকে ইসরাইল কোনোক্রমেই পছন্দ করেনি; যদিও সেক্যুলার রাজনৈতিক দল ফাত্তাহের নেতাদের সাথে ইসরাইলের বনিবনা ছিল মোটামুটি। তাই, ২০০৭ হামাস যখন গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন থেকেই ইসরাইল গাজার উপর অবরোধ আরোপ করে; যা আজও চলমান। মূলত, কোনো প্রকার আপোষের আদর্শে বিশ্বাস করে না বলেই ইসরাইল হামাসের উপর এতটাই ক্ষিপ্ত।

Gaza Siege 2007
২০০৭ সাল থেকে গাজার চারিদিকে এই লোহার সীমান্ত দাঁড় করানো হয়েছে; গাজা এখনো Open Air Prison নামে পরিচিত।

হামাসের মহান নেতারা

হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে এর সবচেয়ে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া এর মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের একটি দল, যারা হলেন: আবদেল আজিজ আল-রান্তিসি, আবদেল ফাত্তাহ দুখান, মুহাম্মদ শামা, ইব্রাহিম আল-ইয়াজুরি, সালাহ শেহাদেহ ও ইসা আল-নাশার। একইসাথে, বর্তমান সময়ে ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মতো নেতারা হামাসকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

yahya sinwar and ismail haniyeh
(বাম থেকে) ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনওয়ার।

সামরিক তৎপরতা

হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার আগে ১৯৮৬ সালে সালাহ শেহাদেহের নেতৃত্বে "ফিলিস্তিনি মুজাহিদিন" নামে একটি সামরিক শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কাতাইব ইজ্জিদ্দিন আল-কাসাম (كتائب عز الدين القسام) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বর্তমানে "আল-কাসাম ব্রিগেড" নামে পরিচিত হয়। তৎকালে এর নেতৃত্বে ছিলেন সালাহ শেহাদেহ, এবং তারপর মুহাম্মদ আল-দেইফ তার স্থলাভিষিক্ত হন।

Abu Ubaida
আল কাসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা

ইসরাইল দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসর যুক্তরাষ্ট্রের তুলনা হামাসের সামরিক শক্তি ধুলাবালির ন্যায়। কিন্তু, তারপরও ননীর পুতুল সদৃশ ইসরায়লি সেনারা হামাসের সাথে সম্মুখ সমরে যাওয়ার সাহস পায়না; তারা ভিডিও গেম খেলার মতো দূর থেকে ড্রোন পাঠিয়ে আল-কাসাম ব্রিগেডের সদস্যদের হত্যার চেষ্টা করে এবং মাঝে মাঝে সফল হয়। অন্যদিকে কার্পেট বোম্বিং করে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারে, কিন্তু, হামাস খুঁজে পায় না। অন্যদিকে, ঐ ইসরায়লি সেনারা যখন সম্মুখ সমরে গাজার রাস্তায় হাটে, তখনই মা রা পড়ে। কারণ, ফিলিস্তিনের মাটি ফিলিস্তিনিদের, ইউরোপ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসাদের নয়।

শেষকথা

হামাস কি তাদের লক্ষ্যে সফল হবে? এই প্রশ্নের উত্তর, না। এটা বলা সহজ ও যৌক্তিক। কিন্তু, মানুষের ভাগ্য কবেই বা সহজ আর যৌক্তিক ছিল! গতানুগতিকতা ভেঙেই তো বিপ্লব হয়। কিন্তু, একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যতদিন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর একতা না আসবে, তারা এক উম্মত, এক দেহ নীতিতে বিশ্বাসী ও কর্মতৎপরতা না হবে, ততদিন পর্যন্ত কুদস অপবিত্র থাকবে।

কারণ, ইসরাইলকে পুরো ইউরোপ আমেরিকা নিঃশর্তভাবে সমর্থন করে; ইউরোপীয় দেশগুলো ভাবে ইহুদিদের উপর হিটলার বিশাল নির্যাতন করেছে, তাই নিজেদের আবাসভূমি নিরাপদ করতে ইসরাইলের যেকোনো কর্মকাণ্ড বৈধ। অন্যদিকে, আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাই তাদের দেশের একটি অংশ তারা ঠিক আরব রাষ্ট্রগুলোর মাঝে বসিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদের প্রভাবশালী একটি অংশ ইহুদী কিংবা তাদের অনুগত। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র তারা নির্দ্বিধায় ইসরাইলে পাঠায়।

Gaza
বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত গাজা

তাহলে হামাসের পক্ষে কিভাবে সম্ভব নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করা, ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হওয়া নাগরিকদের দেশে ফেরত আনা, যদি অন্য কোনো পরাশক্তি ইউরোপ আমেরিকার হঠকারিতা প্রতিরোধ করবে। সুতরাং, এটা স্পষ্ট ইসলামী পরাশক্তিই পারে হামাসের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে, হামাস নিজে নিজে পারবে, যেমন উমর (রা:) ছিলেন, যেমন ছিলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।

Tags:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)