পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Emadul Mubin
By -
0

 


খলিফা মামুনের দরবারে মাঝে মাঝে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পন্ডিত ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণের অনুমতি ছিল। এমনই এক আলোচনা সভায় জনৈক ইহুদী পন্ডিত আগমন করল। আকার-আকৃতি, পোশাক ইত্যাদির দিক দিয়ে তাকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে হচ্ছিল। তদুপরি তার আলোচনা ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল, অলঙ্কারপূর্ণ এবং বিজ্ঞজন সুলভ। সভাশেষে মামুন তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি ইহুদি? সে স্বীকার করল। মামুন পরীক্ষার্থে তাকে বললেন, আপনি যদি মুসলমান হয়ে যান, তবে আপনার সাথে চমৎকার আচরণ করা হবে।


সে উত্তরে বলল: আমি আমার পৈত্রিক ধর্ম বিসর্জন দিতে পারিনা। কথাবার্তা এখানেই শেষ হয়ে গেল। লোকটি চলে গেল। কিন্তু এক বছর পর সে মুসলমান হয়ে আবার দরবারে আগমন করল এবং আলোচনা সভায় ইসলামী ফিকাহ সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তৃতা ও যুক্তিপূর্ণ তথ্যাদি উপস্থাপন করলো। সভাশেষে মামুন তাকে ডেকে বললেন: আপনি কি ঐ ব্যক্তি যে বিগত বছরে এসেছিল? সে বলল: হ্যাঁ, আমি ওই ব্যক্তি বটে। মামুন জিজ্ঞেস করলেন তখন তো আপনি ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃত ছিলেন, এরপর এখন মুসলমান হওয়ার কি কারণ ঘটলো?


সমসাময়িক গ্রন্থে অঙ্কিত খলিফা মামুনের দরবার; Image Source: Wikimedia Commons.


সে বলল: এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমি বর্তমান কালের বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করার ইচ্ছা করি‌। আমি একজন হস্তলেখাবিশারদ। স্বহস্তে গ্রন্থাদি লিখে উঁচু দামে বিক্রয় করি। আমি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিনটি কপি লিপিবদ্ধ করলাম। এগুলোতে অনেক জায়গায় নিজের পক্ষ থেকে বেশ কম করে লিখলাম। কপিগুলো নিয়ে আমি ইহুদীদের উপাসনালয়ে উপস্থিত হলাম। ইহুদীরা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে কপিগুলো কিনে নিল। অতঃপর এমনিভাবে ইঞ্জিলের তিন কপি কম-বেশ করে লিখে খ্রিস্টানদের উপাসনালয়ে নিয়ে গেলাম সেখানেও খ্রিস্টানরা খুব খাতির যত্ন করে কপিগুলো আমার কাছ থেকে কিনে নিল। এরপর কুরআনের বেলায়ও আমি তাই করলাম। এরও তিনটি কপি সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করলাম এবং নিজের পক্ষ থেকে কম-বেশ করে দিলাম। এগুলো নিয়ে যখন বিক্রয়ার্থে বের হলাম তখন যে-ই দেখল সে-ই প্রথমে আমার লেখা কপিটি নির্ভুল কিনা, যাচাই করে দেখল। অতঃপর বেশকম দেখে কপিগুলো ফেরত দিয়ে দিল। এ ঘটনা দেখে আমি এই শিক্ষায় গ্রহণ করলাম যে গ্রন্থটি হুবহু সংরক্ষিত আছে এবং আল্লাহ নিজেই এর সংরক্ষক। এরপর আমি মুসলমান হয়ে গেলাম।


ঘটনাটি ইমাম কুরতুবী তাঁর তাফসির গ্রন্থে সূরা হিজরের ৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় সনদসহ বর্ণনা করেছেন।[১] হাজার বছর ধরে মৌখিক ও লিখিত উভয় পদ্ধতিতে পবিত্র কুরআন সংরক্ষিত হয়ে আসছে। আর এই উভয় পদ্ধতিতে  সম্মানিত গ্রন্থটি সংরক্ষণের প্রবক্তা স্বয়ং আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)। তাঁর জোরালো ভূমিকা পরবর্তী যুগে পবিত্র কুরআনকে একটি নির্ভেজাল ও অবিকৃত গ্রন্থ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোন আয়াত নাজিল হওয়ার সাথে সাথেই তিনি তাঁর সাহাবীগণকে তা মৌখিক ও লিখিত আকারে আয়ত্ত করতে নির্দেশ দিতেন। এই কারণেই সাহাবীগণ কতৃক সংকলিত কুরআন সম্পূর্ণ সন্দেহাতীত।


বর্তমানে আমাদের কাছে যে কুরআন শরীফ রয়েছে তা হুবহু সেই গ্রন্থ, যা আল্লাহ তাআলা হযরত জিব্রাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ)-এর উপর নাযিল করেছেন। রাসূল (সাঃ) কুরআনকে যেভাবে নিজের সামনে লিখিয়েছেন, যেভাবে সাহাবীগণকে মুখস্ত করিয়েছেন, তিনি নিজে পাঠ করেছেন এবং সাহাবীগণকে পাঠ করার শিক্ষা দিয়েছেন, সেই অবস্থায় এবং সেই বিন্যাসে এখনো তা বিদ্যমান আছে। এর বিন্যাসে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হয়নি, না কোনরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন বর্ণ বা বাক্যতে কোন প্রকার রদবদল ঘটেনি।


বার্মিংহাম পান্ডুলিপি, এটিই পবিত্র কুরআনের প্রাচীনতম নিদর্শন। ধারণা করা হয়, ৫৬৮-৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এটি রচিত; Image Source: University of Birmingham


মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় অন্তর্কোন্দল হলো শিয়া-সুন্নি মতবিরোধ। ইসলামের অনেক বিষয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও পবিত্র কুরআনের একটি বর্ণের ব্যাপারেও তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। যদিও শিয়ারা মাসহাফে উসমানীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।[২] এতদসত্ত্বেও এই উভয় গোষ্ঠীর ব্যবহৃত পবিত্র কুরআনে সামান্যতম পার্থক্য নেই।[৩] শিয়া ও সুন্নিদের এই মতৈক্য মহাগ্রন্থ কুরআনের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি করেছে। উভয় পক্ষের মতামত এই সংরক্ষণ ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ ও সন্দেহাতীত।


বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের থেকে বড় ধর্মীয় গোষ্ঠী হল খ্রিস্টানরা। বিশ্বব্যাপী তারা দুইভাগে বিভক্ত ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট। কিন্তু তাদের এই দুই গোষ্ঠী পবিত্র বাইবেলের অধ্যায় সংখ্যা নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত। ক্যাথলিক মত অনুযায়ী তাদের ধর্ম গ্রন্থের মোট অধ্যায় সংখ্যা ৭৩ টি। অন্যদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট মত অনুযায়ী মোট অধ্যায় সংখ্যা হল ৬৬ টি। প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিকদের অতিরিক্ত ৭ অধ্যায়কে বাইবেলের অংশ হিসেবে স্বীকার করে না। পবিত্র কুরআনের ব্যাপারে এই ধরনের কোন দ্বিধাবিভক্তি নেই। কারণ রাসূল (সঃ) এর প্রতিটি অধ্যায় ও আয়াতের বিন্যাস নির্ধারণ করে গেছেন। অন্যদিকে পবিত্র বাইবেল সংকলন করা হয় যীশু খ্রীষ্টের মৃত্যুর কয়েক দশক পর।[৪]


রাসূল (সাঃ)-এর সময়ে কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতি

ওহী অবতীর্ণ হওয়ার শুরু থেকেই মহাগ্রন্থ কুরআন লেখার ধারা আরম্ভ হয়। রাসুল (সাঃ) নিজে লিখতে না জানলেও তিনি তাঁর সাহাবীগণের দ্বারা তা লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। তাঁর উপর যখনই কোন আয়াত নাজিল হতো, তখনই তিনি তা শুধু মুখস্থ করার নয় বরং লিখে রাখারও নির্দেশ দিতেন। এরপর রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক আয়াতের ব্যাপারে লেখকগণকে বলে দিতেন যে, এই আয়াত অমুক সূরার প্রথমে বা শেষে যোগ করা হবে। ঐ সময়ে লেখার উদ্দেশ্যে সাদা পাথরের টুকরা, গাছের ছাল, কাঠ, পত্র, উটের কাঁধের হাড়, কাপড় এবং কোন কোন সময় কাগজের ব্যবহার করা হতো। একই সূরা বা আয়াত একাধিক স্থানে লিপিবদ্ধ করা হতো।


যে সকল সাহাবি ওহী লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করতেন তাঁদেরকে কাতেবে ওহী বা ওহী লেখক বলা হয়। তাঁরা সকলেই ছিলেন প্রথম স্তরের সাহাবী। এ সকল লেখক সাহাবীর মধ্যে হাদিস ও সিরাত গ্রন্থসমূহে নিম্নলিখিত সাহাবীদের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা বিভিন্ন সময়ে এই দায়িত্ব পালন করেছেন: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ), উমর ফারুক (রাঃ), উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ), আমীর মুআবিয়া (রাঃ), আবান ইবনে সাঈদ (রাঃ), খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ), সাবিত ইবনে কায়স (রাঃ), যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ), উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ), আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রাঃ), হানজালা ইবনে রাবী (রাঃ) এবং আবু রাফি কীবতী (রাঃ)।[৫]


ওই লেখকগণ তাদের কাছে লেখার মত যে সব জিনিস পেতেন তার উপর লিখতেন। এই ছবিটি প্রতিকী আসল নয়। Image Source: Onepath Network.

রাসূল (সঃ)-এর উপর কোন আয়াত বা সূরা অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে তিনি উক্ত লেখকদের যে কাউকে ডেকে নিয়ে তা লিপিবদ্ধ করিয়ে রাখতেন। হযরত বারা (রাঃ) বলেন, 


"যেসব ঈমানদার (জেহাদে না গিয়ে ঘরে) বসে থাকে তারা এবং নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদকারীরা সমান হতে পারে না।" আয়তটি নাজিল হলে নবী (সাঃ) বললেন, যায়েদকে আমার কাছে ডেকে আন এবং তাকে বল সে যেন কাষ্ঠখণ্ড, দোয়াত ও কাঁধের হাড় নিয়ে আসে। রাবী বলেন, অথবা তিনি বলেছেন, কাঁধের হাড় এবং দোয়াত নিয়ে আসে। এরপর (যায়েদ ইবনে সাবিত তাঁর কাছে আসলে) তিনি বললেন, লিখ। এসময় তাঁর পিছনে অন্ধ সাহাবী আমর ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) বসা ছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমি তো অন্ধ, আমার ব্যাপারে আপনার কি নির্দেশ? এ কথার প্রেক্ষিতে পূর্বোক্ত আয়াতের পরিবর্তে নাজিল হল, "যেসব ঈমানদার অক্ষম নয় অথচ (জেহাদে না গিয়ে ঘরে) বসে থাকে তারা এবং নিজেদের জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদকারীরা সমান হতে পারে না।" (৪:৯৫) [৬]


পবিত্র কুরআন সংকলনের সরকারি উদ্যোগ

১১ হিজরী সনে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধে অসংখ্য হাফেজ সাহাবী শহীদ হন। এই সংখ্যা এত বেশি ছিল যে মক্কা ও মদীনায় হাফেজদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যায়। এই অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উমর (রাঃ) খলিফা আবু বকর (রাঃ)-কে পবিত্র কুরআন সংকলনের প্রস্তাব দেন। আবু বকর (রাঃ) বলেন, যে কাজ রাসূল (সঃ) করেননি, সেই কাজ তিনি কিভাবে করবেন? উমর (রাঃ) তাকে আশ্বস্ত করেন যে, এটি অবশ্যই একটি উত্তম কাজ। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে কুরআন বিষয়ক কোনো মতবিরোধ সৃষ্টি হবে না। সুতরাং আবু বকর (রাঃ) তাঁর কথায় আশ্বস্ত হয়ে উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। তিনি যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-এর উপর পবিত্র কুরআন সংকলনের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন।


মুসলিম বাহিনী; Image Source: Al Jazeera/Omar TV Series.

"আল্লাহর শপথ! তাঁরা যদি আমাকে একটি পাহাড় এক স্থান হতে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিত, তাহলেও তা আমার কাছে কুরআন সংকলনের নির্দেশের অপেক্ষায় কঠিন বলে মনে হত না",

যায়েদ ইবনে সাবিত (রাঃ), সহিহ বুখারী।

যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) বিভিন্ন প্রকার পাতা, সাদা পাথরের টুকরা, কাষ্ঠখণ্ড ও ছালে বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত কুরআন একত্রিত করেন। অতঃপর তাঁর কাছে থাকা লিখিত এবং হাফিজগণের মৌখিক প্রমাণের ভিত্তিতে তিনি একটি পান্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। তাঁর প্রস্তুতকৃত পাণ্ডুলিপিটি সর্বদিক হতে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য ছিল। এটাই কুরআনের প্রথম সরকারি সংকলন। আবু বকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে পাণ্ডুলিপিটি তাঁর নিকট রক্ষিত ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর পান্ডুলিপিটি উমর (রাঃ)-এর অধিকারে সংরক্ষিত থাকে। তাঁর ইন্তিকালের পর পাণ্ডুলিপিটি তাঁর কন্যা উম্মুল মুমিনীন‌ হাফসা (রাঃ)-এর কাছে সংরক্ষিত ছিল।[৭]


যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-এর পান্ডুলিপি তৈরিতে সাহায্য করা হাফেজ সাহাবিগণ সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট পবিত্র কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠের শিক্ষা লাভ করেছেন। অন্যদিকে নিজে হাফেজ হলেও তিনি তৎকালীন প্রায় সকল হাফেজগণের প্রসিদ্ধতম মত গ্রহণ করেছেন। এই কারণেই সম্পূর্ণ কুরআন সম্পর্কে বলা হয় যে, এটি মুতাওয়াতির সনদে বর্ণিত। তাই এর একটি অক্ষর নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর মুতাওয়াতির ঐ হাদীসকে বলা হয় যা এত অধিক সংখ্যক বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত যে, ঐ সকল বর্ণনাকারীদের কোনো মিথ্যার উপর একমত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।


যদিও তৎকালে উক্ত সংকলন ভিন্ন আরো কয়েকটি সংকলনের অস্তিত্ব ছিল। যেমন, উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কতৃক ব্যক্তিগতভাবে সংকলিত পান্ডুলিপি। কিন্তু তাদের ঐ সংস্করণগুলো সকল হাফেজ সাহাবী কর্তৃক সমর্থিত ছিল না। এই কারণে এতো প্রসিদ্ধ সাহাবী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সংকলিত পান্ডুলিপি বাদ পড়ে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর মতে, তিনটি সূরা (সূরা ফাতিহা, ফালাক, নাস) কুরআনের অংশ নয়। যদিও তিনি এই সূরাগুলোর অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি। বরং এ বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কেন তিনি সূরা ফাতিহাকে তাঁর মুসহাফে উল্লেখ করেননি। তিনি জবাবে বলেছিলেন,


“যদি লিপিবদ্ধ করতামই, তাহলে আমি একে প্রত্যেক সুরার আগে লিপিবদ্ধ করতাম।”


হযরত উসমান (রাঃ)-এর খেলাফত 

উসমান (রাঃ)-এর যুগে হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) আজারবাইজানে রণ প্রস্তুতির সময় ইরাকি ও সিরীয় সৈন্যদের মধ্যে কুরআন পাঠে উল্লেখযোগ্য মতবিরোধ লক্ষ্য করেন। এরপর তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে কুরআন পাঠের পার্থক্য সম্পর্কে খলিফার আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই সমস্যা সমাধানে খলিফা যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-সহ চারজনের একটি কমিটি গঠন করেন। তিনি উক্ত কমিটিকে এই মর্মে নির্দেশ দেন যে, কুরআন লিপিবদ্ধকরণে যেন কুরাইশী রীতি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া হাফসা (রাঃ) এর কাছে রক্ষিত কপিটি তিনি আনার ব্যবস্থা করেন। যাতে কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা না দেয়।[৮]


উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ) সাত পদ্ধতিতে (সাব'আতু আহরুফিন) কুরআন পাঠের অনুমতি দিয়েছিলেন।[৯] অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, এই সাত পদ্ধতি দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল, আরবে তৎকালীন প্রসিদ্ধ সাত গোত্রের ভিন্ন পঠনরীতি। তবে শব্দের উচ্চারণে তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তা অর্থ পরিবর্তন করত না। এটা ছিল আরবি ভাষার আঞ্চলিকতার পার্থক্য। ঐ গোত্রগুলোর মধ্যে স্বয়ং রাসূল (সাঃ) ছিলেন কুরাইশদের অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে ভিন্ন পঠনরীতির কারণে যাতে কোন প্রকার বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়, বিশেষ করে অনারব অঞ্চলে, তাই উসমান (রাঃ) সকলকে কুরাইশী পঠনরীতির উপর একত্রিত করেন।


উক্ত কমিটি কর্তৃক কুরাইশী রীতি অনুসারে প্রস্তুতকৃত কপির ভিত্তিতে আরও অনেক গুলো কপি তৈরি করে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এরসাথে যেই সকল অঞ্চলে কপি প্রেরণ করা হয়েছিল, সেই অঞ্চলগুলোতে কুরআন পাঠে অভিজ্ঞ কারীদের নিয়োজিত করেন। ঐ কপি তখন মাসহাফে ইমাম নামে প্রচলিত ছিল।[১০] বর্তমানে তা মাসহাফে উসমানী নামে পরিচিত।


উসমান (রাঃ) আরবের বিভিন্ন স্থানে রাসূল (সাঃ)-এর সময়ের যে খন্ড খন্ড লিখিত কুরআন রক্ষিত ছিল তা ধ্বংস করে দেন। যাতে ভবিষ্যতে কেউ উক্ত বিচ্ছিন্ন খন্ডগুলোকে পূর্ণ কুরআন বলে দাবি করতে না পারে। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রঃ) আল-ইতকান গ্রন্থে আল-মুহসীবির উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন,

“সাধারন্যে প্রসিদ্ধ আছে, উসমান (রাঃ) কুরআন সংগ্রহকারী ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি তা ছিলেন না।”[১১]

তিনি খলিফা আবু বকর (রাঃ)-এর আমলে সংকলিত কুরআনের হুবহু কপি তৈরি করেন। এর জন্য তিনি যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-কে নিয়োগ দেন। সুতরাং উসমান (রাঃ) নন, বরং আবু বকর (রাঃ)-ই পবিত্র কুরআনের প্রথম ও প্রকৃত সংকলক। মূলত এই মহাগ্রন্থ সম্পর্কে যাতে ভবিষ্যতে কোন প্রকার বিভ্রাটের সৃষ্টি না হয় তার জন্য তিনি দূরদর্শী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। 


লিখন পদ্ধতি

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ব থেকেই আরব উপদ্বীপে হেজাজি লেখ্যরীতি প্রচলিত ছিল। কুরআন নাজিলের শুরু থেকেই তা উক্ত রীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে সাহাবীদের যুগেও উক্ত রীতি অনুসৃত হয়। কারণ যে সকল সাহাবী লিখতে পারতেন তারা সবাই ঐ রীতিতে পারদর্শী ছিলেন। বর্তমানে প্রচলিত আরবি লেখ্যরীতির সাথে তৎকালীন হেজাজি লেখ্যরীতির যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তবুও শুধু কুরআনের ক্ষেত্রে এখনও ঐ রীতির অনেক নিয়ম অনুসরণ করা হয়। [১২]


সেই সময় লেখার পদ্ধতি এইরূপ ছিল যে, কোন শব্দের ভিতরে আলিফ (ا) থাকলে তা লিখা হত না। বিশেষত পবিত্র কুরআন লেখার ক্ষেত্রে এর পদ্ধতি এইরূপ ছিল: যেমন, ُاَلْكِتَاب (আল-কিতাব) ُاَلْكِتٰب রূপে এবং َاَلظَّالِمِيْن (আজ-জালিমীন) َاَلظّٰلِمِيْن রূপে লেখা হত। [১৩]


অন্যদিকে রাসূল (সঃ)-এর পরবর্তী যুগে কুরআনে নুকতা ও হরকত সংযুক্ত করা হয়। এই সংযুক্তির কারণ ছিল অনারব মুসলমানদের জন্য কুরআন পাঠ সহজ করা। যদিও তৎকালীন আরবদের এই সকল নুকতা বা হরকতের প্রয়োজন ছিল না। কারণ মাতৃভাষা হওয়ায় তারা বর্ণের পার্থক্য ধরতে পারত। আর এই সংযুক্তির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যে এর দ্বারা কুরআনের আয়াতসমূহের কোন অর্থগত বা ভাবগত পরিবর্তন ঘটেনি।


শেষকথা

বর্তমান পৃথিবীতে সর্বাধিক মুদ্রিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে হলো পবিত্র কুরআন অন্যতম। এর মুদ্রণসংখ্যা তিন বিলিয়নের বেশি। তবে কুরআনের ক্ষেত্রে এই সংখ্যার সাথে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর মুখস্থকারী সংখ্যা। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মহাগ্রন্থটি হুবহু মুখস্থ করছে। ইসলামের ইতিহাসে এমন কোন যুগ অতিক্রান্ত হয়নি, যখন কোন হাফেজে কুরআনের অস্তিত্ব ছিল না। সময় যত গড়াচ্ছে এর লিখিত কপি এবং মুখস্থকারী হাফেজের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতেই একজন মুসলিম পবিত্র কুরআন সংরক্ষণের ব্যাপারে মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতির কথা অনুধাবন করতে পারবে।

“আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক,

আল-কুরআন (১৫:৯)

তথ্যসূত্র ও টীকা:


[১] তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন, ৫ম খন্ড, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (অনূদিত), পৃঃ ২৫০, ১২তম মুদ্রণ,  মে ২০১৮, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।


[২] Hossein Modarressi, "Early Debates on the Integrity of the Qur'an: A Brief Survey." Studia Islamica, no. 77, 1993, pp. 5-39. JSTOR, www.jstor.org/stable/1595789.


[৩] সমসাময়িক শিয়া ও সুন্নি পন্ডিতগণের রচিত তাফসিরে অনুসন্ধান করলে এই অভিন্নতার প্রমাণ মিলবে। ব্যাখ্যায় ভিন্নতা থাকলেও মূল আয়াতে কোনো পার্থক্য নেই। আর অধিকাংশ শিয়া ৩০ পারা কুরআনই ব্যবহার করে।


[৪] বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান, মরিস বুকাইলি (মূল), আখতার-উর-আলম (অনূদিত), পৃঃ ৬, ৮ম সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০০, পুনঃমুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৫, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী।


[৫] কুরআন পরিচিতি, ইসলামী বিশ্বকোষ সম্পাদনা পরিষদ (সম্পাদিত), পৃঃ ৫১-৫২, ১ম সংস্করণ, জুন ১৯৯৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।


[৬] বুখারী শরীফ, ৮ম খন্ড, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক অনূদিত, ২য় সংস্করণ, পৃঃ ৩৩৯, হাদিস নং ৪৬২৪। 


[৭] প্রাগুক্ত(৬), পৃঃ ৩৩৬, হাদিস নং ৪৬২১।


[৮] প্রাগুক্ত(৬), পৃঃ ৩৩৮, হাদিস নং ৪৬২২।


[৯] প্রাগুক্ত(৬), পৃঃ ৩৪১, হাদিস নং ৪৬২৬।


[১০] কুরআন পরিচিতি, ইসলামী বিশ্বকোষ সম্পাদনা পরিষদ (সম্পাদিত), পৃঃ ৫১, ১ম সংস্করণ, জুন ১৯৯৫, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।


[১১] প্রাগুক্ত (১০)


[১২] প্রাগুক্ত (১০), পৃঃ ৫২-৬১।


[১৩] তারিখু-তামাদ্দুন আল-ইসলামী, জুরজী যায়দান, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৫৫, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯২২ সাল, কায়রো।



Tags:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)