আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতায় মুসলিম স্পেনের বহুশাস্ত্রজ্ঞ ইবনে রুশদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। তিনি একাধারে দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিক রূপদানে অবদান রেখেছেন।
![]() |
আন্দ্রেয়া ডি বোনাইউতোর ১৪ শতকের চিত্রকর্মে ইবনে রুশদ; Image Source: www.freespeechhistory.com |
ইবনে রুশদ মুসলিম স্পেনের তথা আন্দালুসিয়ার একজন বহুশাস্ত্রবিদ। তিনি ১১২৬ সালে কর্ডোভায় জন্ম গ্রহণ করেন। আন্দালুসিয়া তার সমসময়ে উমাইয়া রাজবংশ দ্বারা শাসিত ছিল। কারণ ৭৫০ সালে যখন দামেস্কে উমাইয়া রাজবংশের পতনের মাধ্যমে আব্বাসীয়রা ইসলামী খেলাফতের অধিকারী। কিন্তু সেই সময় উমাইয়া এক রাজকুমার আব্দুর রহমান আদদাখিল স্পেনে পালিয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র উমাইয়া ইমারত প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৪৯৮ সাল পর্যন্ত সেই ইমারত টিকে ছিল।
![]() |
স্পেনের কর্দোবায় ইবনে রুশদের প্রতিমূর্তি; Image Source: Wikimedia Commons. |
আব্বাসীয়রা যখন বাগদাদকে কেন্দ্র করে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার নতুন যুগ শুরু করে ছিল তখন আন্দালুসের উমাইয়ারাও পিছনে পড়ে থাকেনি, যদিও তারা রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ছিল। আর যে সকল নাম স্পেনের উমাইয়াদের জ্ঞানবিজ্ঞানের নৌকার পালে হাওয়া দিয়েছে তার মধ্যে ইবনে রুশদের নাম অন্যতম। তবে তিনি যে শুধু অতীতের একজন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব তা কিন্তু নয়, বরং অধুনা জ্ঞানবিজ্ঞান বিশেষ করে দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার মর্যাদা ও অবদান ইবনে সিনা, ইবন খালদুনের ন্যায় মহাঋষিদের সমপর্যায়ে।
ইবনে রুশদের দর্শন ও কর্ম দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের কান্ডারি ইউরোপীয় সভ্যতা। ইউরোপ তাকে চেনে Averroes নামে। পশ্চিমা বিশ্বে তার খ্যাতির প্রধান কারণ হলো এরিস্টটলের গ্রন্থাদি ব্যাখ্যা করার জন্য। এজন্য ইউরোপে তাকে "The Commentator" তথা ভাষ্যকার বা ব্যাখ্যাদাতা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একইসাথে দর্শনে অবদানের জন্য তাকে Father of Rationalism তথা যুক্তিবিদ্যার জনক ডাকা হয়। এছাড়া চিকিৎসায় অবদানের জন্য তাকে Prince of Medicine বলা হয়।
ইউরোপীয় দর্শনে তার প্রভাব
![]() |
প্রাচীন আরবি গ্রন্থে অ্যারিস্টটলের চিত্র; Source: Wikimedia Commons. |
![]() |
The School of Athens, চিত্রশিল্পী রাফায়েললো; Source: Vatican Museums/Wikimedia Commons. |
মধ্যযুগে ইউরোপ আ্যারিস্টটলের দর্শন ভুলতে বসেছিল কিন্তু যখন ইবনে রুশদের ভাষ্যসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় তখন তারা আবার নিজেদের পুরাতন দার্শনিক ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করে। অর্থাৎ ইউরোপীয়দের আজ গ্রিক দর্শন বোঝার পিছনে ইবনে রুশদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সুতরাং, চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে তিনি যুক্তিবিদ্যার জনক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। এমনকি ইতালিতে শুরু হওয়া রেনেসাঁর চিত্রশিল্পী রাফায়েললো তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম The School of Athens এ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে ইবনে রুশদকে স্থান দিয়েছেন। কারণ, তার দার্শনিক ভাষ্যসমূহ ইউরোপীয় রেনেসাঁর জ্ঞানতাত্ত্বিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় অনুঘটক ছিল। বিশেষ করে ধর্ম চিন্তার দিক দিয়ে।
![]() |
সিস্টিন চ্যাপেল, ভ্যাটিকান সিটি; Image Source: Wikimedia Commons. |
ধর্মতত্ত্বের দর্শনে তার প্রভাব
ইবনে রুশদ একজন মুসলিম ছিলেন কিন্তু ধর্মতত্ত্বে তার চিন্তাধারা দ্বারা মুসলিমদের চেয়ে ইউরোপীয়রাই বেশি প্রভাবিত হয়েছে। তার কাছে ধর্মের ব্যাপারে ওহীর পাশাপাশি যুক্তি ও দার্শনিক তত্ত্বাদির বিশেষ মূল্য রয়েছে। বিষয়টি মুলধারার মুসলিম আলেমগণ কখনোই গ্রহণ করেননি বরং তাদের কাছে ওহীর সমপর্যায়ে কোনো কিছু নেই। কিন্তু ইউরোপ যখন রেনেসাঁর সময় তীব্র ধর্মীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল তখন ইবনে রুশদের চিন্তাধারা রেনেসাঁর ধারকবাহকদের নবচিন্তার মূল ভিত্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। এতে ঝামেলায় পড়ে যায় ইউরোপের চার্চ ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা; তৈরি হয় ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন মানব মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তি ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা।
ত্রোয়দশ শতাব্দীতে ইউরোপে ইবনে রুশদের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল দর্শনবাদী ছাত্র রোমান ক্যাথলিক চার্চের দার্শনিক নীতিমালার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এবং তারা নিজেদের Averroes নামে ডাকতো। এমনকি ১২৭০ সালে ফ্রান্সে ইবনে রুশদের দর্শন চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু তার পরও দার্শনিকরা তা থেমে থাকেনি। বরং ষোড়শ শতাব্দীতে এসেও Averroism ইউরোপ জুড়ে দার্শনিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করে। তার দর্শনে প্রভাবিত দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন টমাস আ্যাকুনাস।
![]() |
টমাস আ্যাকুনাস; Image Source: University of Tulsa. |
চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে রুশদের প্রভাব
দার্শনিক হিসেবে ইবনে রুশদের পরিচিতি তার চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী হওয়ার বিষয়টিকে ঢেকে দেয়। তবে তাই বলে চিকিৎসাবিজ্ঞান তার অবদান কোনো অংশে কম নয়। তিনি ২০টিরও বেশি চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় রচনা করেছিলেন যা ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। তার রচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো আলকুল্লিয়াত ফিত তিব্ব যা সাত খন্ডে বিভক্ত একটি চিকিৎসা বিষয়ক বিশ্বকোষ। এই গ্রন্থটি ল্যাটিন ভাষায় Colliget শিরোনামে অনূদিত হয়। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে প্রধান চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে এটি শীর্ষ স্থানীয় ছিল। তিনি সর্বপ্রথম পারকিনসন রোগের উপসর্গ খুঁজে বের করে ছিলেন। এছাড়া চোখের রেটিনা সহ আরো নানা বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন তার গ্রন্থাবলীতে।
![]() |
ল্যাটিন ভাষায় ইবনে রুশদের Colliget-এর প্রচ্ছদ; Source: Wikimedia Commons. |
ইবনে সিনা, আর-রাযী, আজ-জাহরায়ী ও ইবনে রুশদের মতো চিকিৎসকদের আগে পৃথিবীতে চিকিৎসাবিজ্ঞান বলতে ঝাড়ফুঁক আর ভেষজের ব্যবহার বুঝাতো, যদিও গ্রিক, ইন্ডিয়ান, মিসরীয়রা উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথে হাঁটলেও তা পূর্ণতা পায় তাঁদের হাত ধরে। কিন্তু তাদের হাত ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞান নবরূপ ধারণ করে। রোগের উপসর্গ নির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ করন, শল্যবিদ্যা ইত্যাদি নানা বিষয় আজ স্বাভাবিক মনে হলেও এর শুরু হয়েছিল ঐ চিকিৎসকদের মাধ্যমে।
যদিও ইবনে রুশদ ইউরোপীয় অন্যান্য জ্ঞানতাত্ত্বিক অঙ্গনে প্রভাব রেখেছেন, কিন্তু দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে তার প্রভাব আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রকে সম্ভব করার ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করেছে।
Key Words: Averroism, Averros, Colliget, Philosophy, Medicine, ইবনে রুশদ, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা
References:
2. How Did Averroes Influence the West?
3. Revisiting Averroes Influence on Western Philosophy, Anthony Raphael Etuk, LWATI: A Journal of Contemporary Research 2022, 19 (1): 174-194.