এরিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর একজন বহুবিদ্যাজ্ঞ যিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। দর্শন, জীববিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান সহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তবে দার্শনিক হিসেবে তার খ্যাতি তার অন্যসব পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনকি অনেকের কাছে, পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের তালিকায় শীর্ষে তার অবস্থান অবিসংবাদিত। নীতিশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনে তার প্রণীত বিভিন্ন চিন্তাধারা আজও হাজার বছর পর পৃথিবীর আধুনিক দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।
আসুন প্রাচীন গ্রিসের এই মহা মনীষী সম্পর্কে সামান্য ধারণা নেওয়া যাক:
এরিস্টটল প্রাচীন মেসিডোনিয়ার স্তাগিরা (Stagira) শহরের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (বর্তমানে তা আধুনিক গ্রিসের অংশ)। অল্প বয়সেই তিনি এথেন্সে পাড়ি জমান প্লেটোর অধীনে তার একাডেমিয়ায় অধ্যায়নের জন্য। এরিস্টটল একাডেমিয়ায় ২০ বছর অতিবাহিত করেন; প্রথমে ছাত্র হিসেবে পরবর্তীতে শিক্ষক হিসেবে। এথেন্স ত্যাগ করার পর এরিস্টটল আলেকজান্ডার নামে এক যুবরাজের গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, এই আলেকজান্ডারই ছিলেন পরবর্তীতে বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট।
![]() |
শিল্পীর তুলিতে আলেকজান্ডারকে এরিস্টটলের দীক্ষা দেওয়ার চিত্র; Image Source: Wikimedia Commons |
এরিস্টটলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
নীতিশাস্ত্রে এরিস্টটলের
গত আড়াই হাজার বছর পরেও এরিস্টটল নীতিশাস্ত্রের তত্ত্ববিদ হিসেবে নিজের অবস্থান হারাননি। মধ্যযুগে ইবনে রুশদ, ইবনে সিনার মতো মুসলিম দার্শনিকরা ব্যাপকভাবে এরিস্টটলের দর্শন ও নীতিশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে ঐ মুসলিম মনীষীরা স্বাধীনভাবে অনেক তত্ত্ব আবিষ্কার করলেও তাদের উপর এরিস্টটলের প্রভাব অনস্বীকার্য। এমনকি এরিস্টটলের নানাবিধ তত্ত্ব সম্পর্কে তাদের আলোচনা ও ব্যাখ্যা পরবর্তীতে ইউরোপীয়দেরকে এরিস্টটলের দর্শন বুঝতে সহায়তা করে।
![]() |
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে তৈরি প্রতিকৃতির নমুনা; Source: Wikimedia Commons |
আধুনিক যুগে ইমানুয়েল কান্টের মত নীতিশাস্ত্রবিদ যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলেও এরিস্টটল আজও নীতিশাস্ত্রে স্বমহিমায় দেদীপ্যমান। এরিস্টটলের নীতিশাস্ত্র মূলত দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজে: প্রথমত, সুন্দর জীবনযাপন বলতে কি বোঝায়? দ্বিতীয়ত, মানুষ কিভাবে সেই সুন্দর জীবনযাপন অর্জন করতে পারে? একইসাথে, তিনি মানব জীবনে জ্ঞানের বাস্তবিক প্রয়োগের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
ইউরোপের উপর তার প্রভাব
তবে অনেক মুসলিম মনীষী এরিস্টটলকে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করলেও তার নীতিশাস্ত্রে যুক্তিবিদ্যার প্রাধান্যের কারণে ইসলামী সমাজে তা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারেনি। কেননা মূলধারার মুসলিম আলেমগণ পবিত্র কুরআন ও হাদীসের পাশাপাশি যুক্তিবিদ্যার আধিক্যকে ভালো চোখে দেখেন না। যদি ইসলামী ইতিহাসে মুতাজিলাদের মতো কিছু গোষ্ঠী ছিল যারা গ্রিক যুক্তিবিদ্যাকে ব্যাপক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে এবং সেই আলোকে ইসলামী দর্শনের ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছে। তবে তারা কোনোভাবেই মূলধারার আলেমগণের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি।
অন্যদিকে, ইউরোপীয়রা এরিস্টটলের নীতিশাস্ত্রকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কারণ মধ্যযুগে খ্রিস্টান চার্চের নীতিগত ব্যর্থতা তাদেরকে যুক্তিভিত্তিক গ্রিক নীতিশাস্ত্রের দিকে নিয়ে যায়। এই কারণেই আজ ইউরোপ জুড়ে এরিস্টটলকে এতটাই মহিমান্বিত করা হয়। এমনকি আধুনিক যুগের সকল দার্শনিক ও নীতিশাস্ত্রবিদ কোনো না কোনো ভাবে তার দ্বারা প্রভাবিত।
যুক্তিবিদ্যায় এরিস্টটল
যুক্তিবিদ্যা সম্পর্কে এরিস্টটল যা কিছু বলেছেন তা ছিল তার নিজের আবিস্কার। এমনকি তিনি ঐ বিষয়গুলোকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা চূড়ান্ত বলে বিবেচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট এই কথাকে সমর্থন করে বলেন, "যুক্তির বিষয়ে যা কিছু আবিস্কার করার মতো ছিল এরিস্টটল এর সবকিছুই আবিষ্কার করেছেন।" যদিও এই কথাটিকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে।
তারপরও প্রায় আড়াই হাজার বছর পরেও এরিস্টটল যেভাবে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যাচ্ছেন তাতে তার গুণকীর্তনে এই অতিরঞ্জন দোষের কিছু নয়! কেননা আধুনিক যুগে যুক্তিবিদ্যার এতো উন্নয়ন হওয়ার পরও এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার যে মৌলিক গাঠনিক রূপ তৈরি করেছিলেন তা অক্ষত আছে। যেমন মানুষের ভাষা মাঝে মাঝে স্বভাবজাত প্রয়োগের কারণে অস্পষ্টতা সৃষ্টি করে, এরিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা এই সমস্যাকে দূরীভূত করার মাধ্যমে সঠিকভাবে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এরজন্যই তিনি তার Rhetorica গ্রন্থে বক্তৃতা, বাচনভঙ্গি ও ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেছেন।Aristotle by Midjourney AI
জ্ঞানতত্ত্বে এরিস্টটল
এরিস্টটলের জ্ঞানতত্ত্ব অভিজ্ঞতাবাদ তথা Empiricism-এর উপর প্রতিষ্ঠিত। এখন অভিজ্ঞতাবাদ বলতে বোঝায় অভিজ্ঞতাই যাবতীয় জ্ঞানের উৎস। আর এই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় ইন্দ্রিয় দ্বারা পর্যবেক্ষণের ফলাফল হিসেবে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ যা জানে তা শুধু তার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন জিনিস জ্ঞান হতে পারে না। এখানেই মূলত ধর্মের সাথে এরিস্টটলের জ্ঞানতত্ত্বের সংঘাতের সূত্রপাত। কারণ অধিকাংশ ধর্মে স্রষ্টা সহ আরো অনেক বিষয় আছে যা ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রমাণ করা অসম্ভব। **তবে অভিজ্ঞতাবাদ যে সবসময় ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক এমন ধারণা সঠিক নয়।
এখানে উল্লেখ্য যে এরিস্টটলের সমসাময়িক ও পূর্বতন বেশি কয়েকজন জ্ঞানতাত্ত্বিক ছিলেন যারা জ্ঞানতত্ত্বে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাধারা ছিল সংকুচিত। কিন্তু এরিস্টটল যুক্তিবিদ্যার সংমিশ্রণে অভিজ্ঞতাবাদকে আরও ব্যাপক রূপ প্রদান করেছেন। ফলে মানব জীবনের নানাবিধ বিষয় তিনি সফলভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি অনেকের মতে আধুনিক সময়ে এসে এরিস্টটলের সেই অভিজ্ঞতাবাদ থেকেই উদারতাবাদের (Liberalism) উৎপত্তি ঘটেছে।
এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এরিস্টটল নানাভাবে মানব সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছেন। একজন একক ব্যক্তি হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছেন এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে অপ্রতুল।
References:
All the refernces are hyperlinked in the article.
Tags: #Aristotle, #Greek, #Philosphy, #Ancient, #অ্যারিস্টটল, #গ্রীক, #দর্শন, #প্রাচীন #এরিস্টটল