হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আস্-সাকাফী, যদি ইসলামী ইতিহাসের
খলনায়কদের তালিকা তৈরি করা হয়, তাহলে তার নাম নিঃসন্দেহে ঐ তালিকার শীর্ষপর্যায়ে
স্থান পাবে। পবিত্র মক্কা নগরী অবরোধ থেকে শুরু করে সাহাবি হত্যাসহ আরো অনেক গর্হিত
ও নেক্কারজনক কর্মকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে সে ইতিহাস জুড়ে সমালোচিত। এতদসত্ত্বেও রাজনৈতিক
ও সামরিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতার দিক দিয়ে সে ছিল তার যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে
অন্যতম। আর সেই দক্ষতা ও দূরদর্শিতার অংশ হিসেবে সে ইরাকের দজলা নদীর অববাহিকায় ওয়াসিত
নামে একটি শহর নির্মাণ করে। যেখানে বসে সে ইরাকে উমাইয়া খেলাফত বিরোধী বিদ্রোহ দমন
করার সাথে সাথে পুরো ভারতবর্ষের ভিত নাড়িয়ে দিয়ে।
ওয়াসিত মধ্যযুগের একটি জাঁকজমকপূর্ণ ও জনবহুল শহর হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক যুগে এসে এর অস্তিত্বের প্রমাণাদি একেবারেই অপ্রতুল হয়ে গেছে। তবে মধ্যযুগীয় ইতিহাস বিশেষত ইসলামী স্বর্ণযুগ সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকবর্গের জন্য এই ঐতিহাসিক শহরটির অবস্থান এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই প্রবন্ধে সংক্ষিপ্তসারে আমরা উক্ত শহরটির উত্থান-পতন সম্পর্কে আলোকপাত করব।
গোড়াপত্তনের ইতিহাস
খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগাবসানের পর উমাইয়ারা মুসলিম সাম্রাজ্যে বংশানুক্রমিক স্বৈরতন্ত্র তথা রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। তবে সিরিয়ার দামেস্কে অবস্থানরত উমাইয়া খলিফাদের জন্য বারবারই মাথা ব্যাথার কারণ ছিল ইরাকের জনগণ। কেননা উমাইয়া রাজবংশের শাসন বিরোধী প্রায় প্রতিটি বিদ্রোহের আঁতুড়ঘর ছিল ইরাকের মাটি। আর এই সমস্যা সমাধানে ইরাকে উমাইয়াদের এমন একজন প্রতিনিধি দরকার ছিল যে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে হলেও বিদ্রোহ দমন করবে। ঠিক এই কারণেই খলিফা মারওয়ান তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে ইরাক সহ তার সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন। ইতিপূর্বে সে মক্কায় আমিরুল মুমিনীন আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ)-এর উমাইয়া খিলাফত বিরোধী বিদ্রোহের রক্তাক্ত ইতি টেনে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তাই ইরাকের মাটিতেও সে সফল হবে এ নিয়ে খলিফার মনে কোন সংশয় ছিল না।
উমাইয়া যুগের ইরাকে খেলাফত বিরোধী বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিখ্যাত কুফা ও বসরা শহরদ্বয়। একই সাথে দুই শহরে বিদ্রোহ দানা বাধার ফলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে প্রাথমিক পর্যায়ে মোটামুটি হিমশিম খেতে হয়। কারণ বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সে নিজের সাথে করে যে সিরীয় সৈন্যদল নিয়ে এসেছিল তাদেরকে উক্ত শহরদ্বয়ের মধ্যে বারংবার স্থানান্তর করা একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার। অন্যদিকে উক্ত সৈন্যদলটিকে বিভক্ত করে শহরদ্বয়ে অবস্থান করানোর অর্থ হল বিদ্রোহীদের সামনে নিজেদের শক্তিকে অর্ধেক করা। এছাড়া সিরীয় সৈন্যদের সাথে ইরাকী সৈন্যদের সংমিশ্রণ করে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করলে সিরীয়-ইরাকী বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। তাই এই সকল সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিদ্ধান্ত নেয় কুফা ও বসরার মাঝখানে গোটা একটি নতুন শহর তৈরি করার।
ওয়াসিত (واسط) আরবি শব্দ। এর অর্থ মধ্যবর্তী, মাঝখানে অবস্থানকারী। মূলত কুফা ও বসরার শহরদ্বয়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত ছিল বলে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজেই এই শহরটিকে ওয়াসিত নামে নামকরণ করে। যদিও সে আধুনিক মানচিত্র অনুযায়ী ওয়াসিত ঐ শহরদ্বয়ের একেবারে মাঝে না হলেও অন্তত তুলনামূলক দূরত্বের ভিত্তিতে মাঝখানে অবস্থিত ছিল। ভৌগলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে শহরটি ইরাকের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। ত্রয়োদশ শতাব্দী ইতিহাসবেত্তা ইয়াকুত আল-হাময়ীর তার "মুজামুল বুলদান" গ্রন্থে শহরটির নির্মাণ কাল ৮৩-৮৬ হিজরি তথা ৭০২-৭০৫ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। স্বভাবতই পানির চাহিদা পূরণ, যোগাযোগের সুবিধা এবং কুফা ও বসরা শহরদ্বয়ের অবস্থান বিবেচনায় এই শহরটিকে দজলা নদীর অববাহিকায় নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওয়াসিতের স্থাপত্যকলা ছিল সেই যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ। সরকারি স্থাপনা, মসজিদ-মাদরাসা, রাস্তা-ঘাট সহ অন্যান্য স্থাপনার স্থাপত্যশৈলী ছিল অতি মনমুগ্ধকর। এছাড়া হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়কালে নির্মিত একটি প্রাসাদের শীর্ষদেশ একটি সবুজ রঙের সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন গম্বুজ দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়। সেই গম্বুজটি "আল-কুববাতুল খাদরা" নামে খ্যাতি অর্জন করে। পরবর্তীতে বাগদাদ নির্মাণকালে খলিফা আল-মানসুরের প্রাসাদের শীর্ষদেশে ঠিক একই ধরনের গম্বুজ নির্মাণ করা হয় এবং একই নামে নামকরণ করা হয়। তবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সময়কালে শহরটিতে নির্মিত অট্টালিকাসমূহের মধ্যে "দীমাস" নামে একটি বৃহৎ কারাগার ও বেশ পরিচিতি অর্জন করে।
অন্যদিকে কুফা ও বসরা থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণীদের তার নবনির্মিত শহরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এভাবেই শুরু হয় ওয়াসিতের সমৃদ্ধির পথ চলা। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৯৫ হিজরি অনুসারে ৭১৪ সালে ঐ শহরে মৃত্যু বরণ করে এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার বেঁচে থাকাকালীন ওয়াসিতে কেবলমাত্র আরবদের বিশেষত সিরীয়দের বসবাসের অনুমতি ছিল। তবে তার মৃত্যুতে সেই বাঁধা দূরীভূত হয় এবং বিভিন্ন জাতির মানুষ সেখানে বসবাস শুরু করে। কালক্রমে শহরটির অধিবাসীরা একটি মিশ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে সেই মিশ্র জনগোষ্ঠী নিয়ে ওয়াসিত বেশ ভালো পরিমাণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করে। যদিও সেই সমৃদ্ধি বাগদাদের মতো ভূবনসেরা না হলেও পরবর্তী বেশ কয়েক শতাব্দী টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল।
সেনাছাউনি থেকে বাণিজ্যকেন্দ্র
ওয়াসিত প্রতিষ্ঠার মূল কারণ ছিল ইরাকে আগত সিরীয় সৈন্যদের জন্য একটি সুদৃড় দুর্গ এবং সৈন্যছাউনি নির্মাণ করা। আর এর সবকিছুই ছিল হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরিকল্পনা মাফিক। কারণ তার নির্মিত শহরটি ছিল কুফা ও বসরা শহরদ্বয় থেকে প্রায় সমান দূরত্বে। ফলশ্রুতিতে খেলাফত বিরোধী বিদ্রোহের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত উক্ত শহরদ্বয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দুঃসাধ্যতা দূরীভূত হয়। ফলে তাকে যে উদ্দেশ্যে ইরাকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তা একটি শহর নির্মাণের মাধ্যমে সাধিত হয়। এছাড়া প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সিরিয়া থেকে আগত সৈন্যদের জন্য এই শহরটি সারা ইরাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেনা ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
তবে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তার প্রতিষ্ঠিত শহরটির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতো। তাই সে শহরটির পিছনে অর্থ ব্যয় করতে মোটেও কার্পণ্য করেনি। ওয়াসিতের সন্নিহিত অঞ্চলে ইতিপূর্বেই সাসানীয় শাসনামলে জনবসতি স্থাপিত হয়। তবে সে নিজের রাজধানী নির্মাণের জন্য যে পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ নিয়ে এসেছিল তাতে উক্ত অঞ্চলের চেহারা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, উদ্যান ও বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা এমনকি টাঁকশালও নির্মাণ করা হয়। এছাড়া অধিক উন্নত ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থার ফলে নিকটবর্তী শহরগুলো থেকে ওয়াসিতের আবহাওয়া অধিকতর স্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হতে থাকে। শহরটির উন্নত জীবনযাত্রার মান অন্যান্য শহরের অধিবাসীদের আকৃষ্ট করতে থাকে।
হাজ্জাজের সময়ে সাসানিদ মুদ্রা থেকে তৈরীকৃত মুদ্রা। কারণ ইসলামী সাম্রাজ্য তখন পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যের মুদ্রা ব্যবহার করত; Image Source: Wikimedia Commons.
ওয়াসিত উন্নত নাগরিক জীবনযাত্রার পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন ক্ষেত্র খ্যাতি অর্জন করে। তবে কথিত আছে, যে এলাকায় শহরটি নির্মিত হয় তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক বসতি স্থাপনের পূর্বে অনুর্বর ছিল। তার তত্ত্বাবধায়নে শহরটির চারিদিকের ভূমির উন্নয়ন সাধন করা হয়। ফলশ্রুতিতে কয়েক বছরের মধ্যেই ওয়াসিতের শস্যাগার থেকে প্রচুর পরিমাণ শস্য রপ্তানি করা শুরু হয়। এমনকি আব্বাসী যুগে দুর্ভিক্ষের সময় সেখান থেকে বাগদাদে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হতো। এছাড়া ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে ভারতবর্ষ ও দূরপ্রাচ্য থেকে আগত প্রায় প্রতিটি ক্যারাভান অন্তত একবার হলেও এই শহরটিতে প্রবেশ করতো। ফলশ্রুতিতে অতি শীঘ্রই শহরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। সুতরাং এ কথা বলা চলে যে, নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যেই ওয়াসিত পুরো ইরাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়।
জ্ঞান চর্চা
ওয়াসিত যে কেবল একটি শক্তিশালী সেনাছাউনি শহর, কৃষিপ্রধান স্থান কিংবা বানিজ্যকেন্দ্র ছিল তা নয়, জ্ঞান চর্চা, বিশেষকরে মুসলিম ধর্মতত্ত্ব চর্চায়ও শহরটি বেশ খ্যাতি অর্জন করে। এই শহরের অধিবাসীদের মধ্যে বহুসংখ্যক বিখ্যাত ইসলামী আইনবেত্তা ও পবিত্র কুরআন পাঠক ছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ওয়াসিত ভ্রমণ করে বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ঐ শহরের ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের, যাদের অধিকাংশই পবিত্র কুরআন মুখস্থকারী (হাফেজ) ছিলেন এবং শুদ্ধরূপে তা আবৃত্তি করতে পারতেন, ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এছাড়া এ শহরটির জ্ঞানীগুণী অধিবাসীদের মধ্যে পবিত্র কুরআন পাঠ বিদ্যার (ইলমুল- কিরাত) বিশেষজ্ঞ ইসমাইল ইবনে আলী, সুফি ধর্মতত্ত্ববিদ আল-হাল্লাজ ও ইতিহাসবেত্তা ইবনে আলী আব্বাস আহমাদ ইবনে বাখতিয়ার অন্যতম ছিলেন। তাই বলা চলে, মধ্যযুগে ইরাকসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জ্ঞানীগুণীরা বাগদাদ মুখি হলেও ওয়াসিতের জ্ঞান চর্চার ধারা মোটামুটি অব্যাহত ছিল।
ভৌগোলিক অবস্থান ও পতন
পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ওয়াসিতের পতনের ঘন্টা বেজে ওঠে। তবে বহিশত্রুর আক্রমণ কিংবা অন্য কোন রাজনৈতিক কারণে এর পতন ঘটেনি। যদিও উমাইয়াদের পতন ও বাগদাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহরটির মর্যাদা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবুও সেটি টিকে ছিল। বরং ঐ ঐতিহাসিক শহরটির পতন কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভৌগলিক। অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে আকস্মিকভাবে দজলা নদীর মূল স্রোতধারা সংকুচিত ও শুকিয়ে যায় এবং এর গতিপথ পরিবর্তিত হতে থাকে। এতে করে ঐ নদীর সাথে সংযুক্ত যে খালগুলো ওয়াসিত ও এর চারিদিকের ভূমি সিঞ্চিত করছিল, সেগুলোও শুকিয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন একেবারে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায়। পানির অভাবে শহরটির বানিজ্যকেন্দ্রগুলো তাদের জৌলুস হারিয়ে ফেলে। এমনকি শহরটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
ফলে ওয়াসিতের অধিবাসীরা শহরটি পরিত্যাগ করা শুরু করে। ঐ অধিবাসীদের অধিকাংশ পার্শ্ববর্তী ##কুত শহরে বসবাস শুরু করে। আর এই অভিবাসনের পরিমাণ এতো অধিক ছিল যে কুত মোটামুটি ওয়াসিতের উত্তরাধিকারীতে পরিণত হয়। তবে সত্য কথা বলতে আধুনিক পাম্প কিংবা তদ্রূপ কিছু থাকলে হয়তো ওয়াসিতকে রক্ষা করা যেত। কিন্তু তা আর সম্ভবপর হয়নি। কালের আবর্তে ঐ ঐতিহাসিক ও জনবহুল শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে শহরটির বিস্তৃতি, এমনকি ভৌগলিক অবস্থান নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
ওয়াসিতের উত্তরাধিকারী কুত শহর ভৌগলিক অবস্থান
ওয়াসিতের সঠিক ভৌগলিক অবস্থান নির্ণয়ের বিষয়টি মেসোপটেমিয়ার অন্যান্য ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরগুলোর অবস্থান নির্ণয়ের মতো অতি জটিল তবে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগীয় মেসোপটেমিয়ার মানচিত্র অনুযায়ী আরব ও ইউরোপীয় বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভূগোলবিদ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ওয়াসিতের ভৌগলিক অবস্থান দজলা নদীর অববাহিকায় ৩২°৫০' উত্তর অক্ষাংশের আশেপাশে অবস্থিত ছিল। সেই অনুসারে এর অবস্থান বর্তমান কুত শহর থেকে উত্তর দিকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। আর এই উল্লেখিত স্থানে একটি মৃত নদীখাতের তীরে ওয়াসিতের ধ্বংসাবশেষ বলতে কয়েকটি পুরাতন কবর ও একটি প্রাসাদের ভগ্নপ্রায় প্রধান ফটক চোখে পড়ে।
দ্বার্থতা নিরসনে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান ইরাকে ওয়াসিত বলতে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল বোঝায়। মূলত আব্বাসীয় খেলাফতের প্রাথমিক দিক থেকেই কর আদায়ের সুবিধার্থে ওয়াসিত শহর ও এর আশপাশের প্রায় ২০ টিরও বেশি শহরকে অন্তর্ভুক্ত করে ওয়াসিত নামক প্রশাসনিক অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়। তখন থেকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শহরটি ওয়াসিত আল-হাজ্জাজ ও ওয়াসিত আল-উযমা (Great Wasit) উভয় নামে পরিচিত ছিল। তবে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শহরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও ঐ প্রশাসনিক অঞ্চলটি বর্তমান শতাব্দীতে এসেও টিকে রয়েছে। সুতরাং আশা করা যায় জ্ঞানপিপাসু পাঠকবর্গকে আধুনিক মানচিত্র অনুসারে ওয়াসিতের অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখিত তথ্য স্মরণ রাখলে নামকরণ জনিত বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হবে না। এছাড়া ২০০০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এই শহরটিকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
শেষকথা
ওয়াসিত প্রতিষ্ঠা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কর্তৃক গৃহীত মহাপরিকল্পনা গুলোর অন্যতম। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সে প্রায় শতভাগ সফল হয়েছিল। এমনকি প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যু, প্রধান পৃষ্ঠপোষক উমাইয়াদের পতন এবং আব্বাসীয়দের অবহেলা সত্ত্বেও ঐ শহরটি প্রায় সাত শতাব্দী ধরে টিকে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির কাছে এর পরাজয় ঘটে। তবে ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও ওয়াসিত মধ্যযুগের একটি জাঁকজমকপূর্ণ ও জনবহুল শহর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিরদিন লিপিবদ্ধ থাকবে।
This article is in Bangla. It is about Wāsiṭ which was a historical medieval city in Iraq.
Key Words: Hajjaz bin Yusuf, Wasit, Medieval City/হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, ওয়াসিত, মধ্যযুগীয় শহর
References:
1. ইসলামী বিশ্বকোষ, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৫১৭-৫২২ , দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ২০০৭, ইসলামী বিশ্বকোষ বিভাগ, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
2. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, অষ্টম খণ্ড, পৃঃ ৫৭৭-৫৮২, প্রথম প্রকাশ, সেপ্টেম্বর ২০০৭, অনুবাদ ও সংকলন বিভাগ, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
3. Jonathan M. Bloom “The ‘Qubbat Al-Khaḍrā and the Iconography of Height in Early Islamic Architecture.” Ars Orientalis vol. 23, 1993, pp. 135, JSTOR.
4. Wasit - UNESCO World Heritage Centre
Feature Image Credit: Al Jazeera