২০০৭ সালে ৭ জুলাই তথা ০৭/০৭/২০০৭ তারিখ নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। এর ফলে যেমন দেশে দেশে খুশির জোয়ার বয়ে যায়, তেমনি দেখা দেয় গণ অসন্তোষও। এর মধ্যে গ্রিসের এক্রোপোলি কিংবা ইতালির মাতেরা শহরের (Matera) মতো হাজার বছর পুরোনো নির্দশন বাদ পড়ে যায়। এমনকি আইফেল টাওয়ার পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হওয়া সত্ত্বেও এই তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো মিশরের পিরামিড এই তালিকায় স্থান না পাওয়া।
![]() |
একনজরে সপ্তাশ্চর্যসমূহ |
তবে, আসলে সপ্তাশ্চর্যের জন্য নির্বাচিত সেরা সাত নির্দেশনাগুলোকে বাদ দেওয়াও কঠিন। এখন এই সাতটি নিদর্শনের মধ্যে কোনো ক্রম নেই। এখন আসুন এই সপ্তাশ্চর্য সম্পর্কে জানি:
চীনের মহাপ্রাচীর
চীনের মহাপ্রাচীর চৈনিক সভ্যতার এক বিস্ময়জাগানিয়া নির্মাণ। প্রায় ৮,৮৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই মহাপ্রাচীরের নির্মাণকাজ শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৭০০ অব্দে এবং নির্মাণ কাজ চালু ছিল প্রায় ১৬৫০ সাল পর্যন্ত মিং রাজবংশের (Ming Dynasty) শাসনকালে। অর্থাৎ প্রায় দু হাজার বছর ধরে এই মহাপ্রাচীরের নির্মাণকাজ চলেছে। এখন, চীনের মহাপ্রাচীর আদতে একটি প্রাচীর নয় বরং দুইটি সমান্তরাল প্রাচীরের সমন্বয়।
![]() |
চীনের মহাপ্রাচীর; Image Source: Wikimedia Commons |
![]() | |
|
পেত্রা
জর্ডানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পেত্রা (Petra) একটি প্রাচীন ও পরিত্যক্ত শহর। বর্তমানে এই শহরে দৃশ্যমান স্থাপনাগুলোর অধিকাংশ খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে নাবাতিরা (Nabatean Kingdom) নির্মাণ করেছিল। মূলত ওয়াদি মূসা তথা মুসার উপত্যকায় নির্মিত এই স্থাপনার বড় একটি অংশ পাহাড় খোদাই করে নির্মাণ করা হয়েছে। ধারণা করা খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ সাল থেকে সেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তবে খ্রিস্টাব্দের ঠিক সূচনালগ্নে রোমানরা এই শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পাথর খোদাই করে নির্মিত এই শহরের স্থাপনাগুলোর গোলাপী আভার কারণে একে রোজ সিটিও (Rose City) বলা হয়।
![]() |
জর্ডানের পেত্রা; Image Source: Wikimedia Commons |
![]() |
আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের এয়ার বেলুন; Image Source; New7Wonders Foundation |
চিচেন ইতজা
মায়া সভ্যতার সময়ে নির্মিত মেক্সিকোর প্রাচীন শহর চিচেন ইতজা (Chichén Itzá) ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে আমেরিকার বুকে সভ্য মানবসভ্যতার বিকাশের জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই পুরো শহরটিই সপ্তাশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টাব্দের নবম ও দশম শতকে সমৃদ্ধ লাভ করা এই শহর একাধিক স্থাপনার সমন্বয়ে গঠিত। এরমধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পিরামিডের মোট ৩৬৫ টি সিঁড়ি নিয়ে নির্মিত, যা মায়া সভ্যতায় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অস্তিত্ব স্পষ্ট করে।
এছাড়া চিচেন ইতজাকে কেন্দ্র করে গড়ে কৃষি সভ্যতা ঐতিহাসিকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ধারণা করা হয় ৫৫০ সালের দিকে এই শহরে বসতি স্থাপন শুরু হয় এবং ১০০০ সালের দিকে সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই শহরে ৩৫ হাজার মানুষ বসবাস করতো।কলোসিয়াম
রোমের কলোসিয়াম (Colosseum of Rome) খ্রিস্টাব্দের ১ম শতাব্দীতে সম্রাট ভেসপাসিয়ানের আমলে নির্মাণ করা হয়। প্রায় ২৪ হাজার বর্গমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি একটি বহুমাত্রিক স্থাপনা। এখানে একসাথে ৫০ হাজার দর্শক অবস্থান করতে পারে। নাটকের মঞ্চ, গ্লাডিয়েটরদের লড়াই, মানুষ ও হিংস্র পশুর লড়াই ইত্যাদি ছিল কলোসিয়ামের প্রধান আয়োজন। বলা হয়, প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ এবং লক্ষাধিক পশু এখানে মারা গেছে শুধু খেলাধুলার মাধ্যমে মনোরঞ্জনের নিমিত্তে।
![]() |
রোমের কলোসিয়াম; Image Source: Wikimedia Commons |
মাচ্চুপিচ্চু
দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার উপর নির্মিত মাচ্চুপিচ্চু (Machu Picchu) পেরুর ইনকা সভ্যতার উৎকর্ষতার নিদর্শন। ১৯১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক হিরাম বিংহাম (Hiram Bingham) এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি "খুঁজে বের" করেন। তার ধারণা ছিল এই শহরটি স্পেনীয়দের আক্রমণ প্রতিরোধে ইনকাদের দূর্গ। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে এটা ইনকাদের পূণ্যভূমি যেখানে কুমারী নারীরা বাস করতো।
![]() |
পেরুর সাবেক ইনকা সভ্যতার মাচুপিচ্চু; Image Source: Britannica |
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ হাজার মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই শহরটি ১৪৫০ সালের দিকে নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকদের আগমন ও ইনকাদের সাথে তাদের সংঘাতের পর ১৬০০ সালের দিকে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আজ মাচ্চুপিচ্চু ঔপনিবেশিকদের হাতে পরাজিত স্থানীয় আদিবাসীদের স্মৃতি বহন করছে।
তাজমহল
ভারতের মোগল সাম্রাজ্যের নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্যকলার উৎকর্ষতা ও অভিজাত্যের অমলিন প্রতিমা তাজমহল। পৃথিবীব্যাপী ভালোবাসার প্রতীক এই তাজমহল শিল্প, সাহিত্য ও পর্যটনে এক বিশাল জায়গা দখল করে আছে। সম্রাট শাহজাহান ভালবাসার মানুষ মমতাজের সমাধিকে চির স্মরণীয় করে রাখতে দিল্লির আগ্রার যমুনার তীরে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। মমতাজ শাহজাহানের ১৪তম জন্মদানের সময় ১৬৩১ সালে মৃত্যুবরণ করে।
![]() |
আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের এয়ার বেলুনসহ তাজমহল; Image Source: New7Wonders Foundation |
মমতাজের মৃত্যুর পর মোট ২২ বছর ধরে ২০ হাজার শ্রমিকের পরিশ্রমের মাধ্যমে এই সমাধিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। নানা ধরনের মনি মুক্তায় সজ্জিত এই স্থাপনাটি সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের রং বদলায়।
ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমার
আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে মধ্যে সর্বাধুনিক হলো ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমার (Christ The Redeemer)। যিশু খ্রিস্টের এই বৃহদকায় মূর্তিটি রিও ডি জেনিরো শহরের উপকণ্ঠে করকোভাডো পর্বতের উপর নির্মিত। ৩০ মিটার উঁচু এই মূর্তিটি ১৯৩১ সালে নির্মাণ করা হয়। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ব্রাজিলের জনগণের মধ্যে ধর্মভীরুতার উদ্রেক ঘটায় যার ফলে এই মূর্তিটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
![]() |
ব্রাজিলের ক্রাইস্ট দ্যা রিডিমার; Image Source: Pinterest |
পরিশিষ্ট
পিরামিড হলো প্রাচীন আমলের সপ্তাশ্চর্যগুলোর মধ্যে একমাত্র নিদর্শন যা আজও টিকে আছে। এমনকি আধুনিক যুগে এসেও মানুষ এর নির্মাণশৈলীর সঠিক ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারেনি। তবে যে স্থাপনাটি স্বমহিমায় সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় স্থান করে নেওয়া যোগ্যতা রাখা সত্ত্বেও স্থান পায়নি সেটা হলো গিজার পিরামিড।
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৫০০ অব্দে অর্থাৎ প্রায় চার হাজার পূর্বে নির্মিত গিজার পিরামিডগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম স্থাপনার অন্যতম। এই পিরামিডগুলো মিশরের রাজধানী কায়রোর উপশহর গিজার উপকণ্ঠে অবস্থিত, তাই এদের গিজার পিরামিড (Pyramids of Giza) বলা হয়। অবশ্যই গিজার পিরামিড বলতে একক কোনো স্থাপনা বোঝায় না বরং খুফুর পিরামিড, স্ফিংক্সের মূর্তি ও আরো বেশকিছু স্থাপনাকে সপ্তাশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শেষকথা
ভোটের মাধ্যমে সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন আসলে একটি অবাঞ্ছনীয় বিষয়। কারণ আধুনিক বিশ্বে যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার জয়জয়কার সেখানে বিশ্বব্যাপী নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা ঠিক নয়। কারণ, তখন সবাই চাইবে নিজের দেশের ঐতিহাসিক কিংবা উল্লেখযোগ্য নির্দেশনকে জয়ী করতে। তবে যাইহোক বর্তমানে যে নিদর্শনগুলো নির্বাচিত করা হয়েছে তার কোনোটিই ফেলে দেওয়া মতো নয়। আসলে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই ধরনের তালিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
References:
All the references are hyperlinked in the article.