ব্রিটিশরা যখন বাংলায় প্রথম শাসন ক্ষমতা দখল করার কিছু কাল পর ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যাকে ১১৭৬ বঙ্গাব্দ অনুযায়ী ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। আবার তারা যখন ভারত শাসন ছাড়লো তখন আবার বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষে ৪০ লক্ষ বাঙালি মারা পড়েছিল (পঞ্চাশের মন্বন্তর)।
![]() |
বাংলা মন্বন্তরের চিত্র; Image Credit: AI Generated/Jamuna Television |
মানে বাঙালিরা কি এতই নির্বোধ যে পৃথিবীর সব অন্যতম উর্বর ভূমির অধিবাসী হয়েও না খেয়ে মারা গেল নাকি ব্রিটিশরা এতটাই কুচক্রী যে বাঙালিরা তাদের কুটচাল বুঝতেই পারেনি অথবা এই দুর্ভিক্ষগুলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাত্র ব্রিটিশদের আসা-যাওয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই?
নীল চাষ
এখন প্রথম দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গেলে, ব্রিটিশরা পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা দখলের সাথে সাথে বাংলার দেওয়ানির দিকে নজর দিয়েছিল। দেওয়ানি বলতে অর্থ সংক্রান্ত বিষয়কে বোঝাতো। আর বাংলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এর উর্বর ভূমি। অন্যদিকে বিরিজদের নীল দোষের জন্য প্রয়োজন ছিল উর্বর ভূমির। ফলে ব্রিটিশরা নীল বাংলার মাটিতে নীল চাষের জন্য চাষীদের উপরজবরদস্তি চালাতে শুরু করে। তবে আসলে ব্রিটিশদের পক্ষে পুরো বাংলা চাষীদের নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা ছিল না। এই দিক থেকে ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করে বাংলার জমিদারগণ। তার লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করে চাষীদের কে অমানবিক অত্যাচার শুরু করে।
এখন যদি বলা হয় পাট অর্থকরী ফসল তাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ধানের বদলে বেশি বেশি পাঠ উৎপাদন করতে হবে। তাহলে তো দেশের মানুষের খাওয়ার জন্য কিছু থাকবে না। তেমনি করে ব্রিটিশরা জমিদারগণের সাহায্যে বাংলার মাটিতে অত্যাধিক পরিমাণ নীল চাষ শুরু করে। এখন নীল চাষের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতির পাশাপাশি জমির উর্বরতা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে ১৭৭৬ সাল নাগাদ যখন বাংলায় খরা দেখা দেয় তখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে দুর্ভিক্ষের রূপ নেয়।
এখানে দেখা যাচ্ছে বাঙালি জমিদাররা নিজের রক্তের আত্মীয়দের হত্যা করেছে নিজেদের লাভের আশায়। আট ব্রিটিশদের দরকার ছিল বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করার জন্য নীল উৎপাদন বৃদ্ধি করা। আর বাংলার মাটিতে তারা তা সম্ভব করতে পেরেছে। এতে করে কত লাগবে বাঙালি মারা গেল তাতে তাদের কিছু আসে যায় না।
![]() |
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তুলিতে ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ; Image Source: Banglapedia |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা পৃথিবীর মানুষই একটি কঠিন সময়ের পার করেছে। তবে সেই সময়ে ১৯৪৩ সালে বাংলার মানুষ যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল তা তা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিভীষিকাময় ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যস্ত ব্রিটিশ সরকার এই দুর্ভিক্ষের প্রতিকার তো দূরের কথা এদিকে ভ্রুক্ষেপই করেনি। এমনকি অনেক ঐতিহাসিক অভিযোগ করেন যে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের আলোচনায় উইনস্টন চার্চিলের নাম বারবার উঠে আসে। তিনি সেই সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের বিজয়ে তার অবদানের জন্য তাকে জাতীয় নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তিনি যখন নায়ক হতে ব্যস্ত ঠিক তখনই লাখে লাখে বাঙালি দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করে। বাংলায় খাদ্যশস্য পাঠানোর বদলে তিনি মন্তব্য করেন, এই বাঙালিরা ইঁদুরের মতো বংশ বিস্তার করে, তাদের মৃত্যুতে কারো কিছু আসে যায় না।
সুতরাং ব্রিটিশরা বরাবরই বাংলাকে সম্পদ আহরণের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ব্রিটেন ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ সম্পদ নিজের দেশে পাচার করেছিল। আর যদি ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশদের উপস্থিতির হিসাব করা হয় তাহলে ব্রিটিশরা সবচেয়ে বেশিদিন বাংলাকে শাসন করেছে। আর অতীত থেকেই বাংলা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধশালী রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা এতটাই শোষণ করেছে যে এই বাংলার মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে, বাংলার উর্বর মাটি তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি।
![]() |
১৯৪৩ সালের মন্বন্তরে সময় ভারতের মেদিনীপুরের একটি লঙ্গরখানা; Image Source: Pinterest |
জমিদারদের অর্থলোভ
ব্রিটিশদের এই শোষণকার্যে প্রথম থেকেই সাহায্য করেছিল বাংলার হিন্দু জমিদাররা। কারণে হিন্দু জমিদাররা বরাবরই মুসলিম নবাবদেরকে ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই যে হিন্দু জমিদাররা ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করেছিল এমনটি নয়। কেননা বাংলার দুর্ভিক্ষে লাখে লাখে মুসলমানের পাশাপাশি সমানুপাতিক সংখ্যায় হিন্দুরাও মৃত্যুবরণ করে। এরা সবই ছিল নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু ও মুসলমান। বরং কি হিন্দু জমিদাররা চেয়েছিল ব্রিটিশরা বিশ্বব্যাপী ব্যবসা করার মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকা লাভ করছে তার থেকে কিছু ভাগ নেওয়ার জন্য। মূলত অর্থের প্রতি লোভের কারণে ঐ জমিদাররা নিজের মাতৃভূমির ভাইদেরকে হত্যায় সাহায্য করে।
খাদ্যশস্য মজুদকরণ
এছাড়া, খাদ্যশস্য মজুদের মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি প্রবণতা দুর্ভিক্ষের বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। ব্রিটিশরা ব্যবসা করে মোটা অঙ্কের লাভ হাসিলের চেষ্টায় ছিল এবং বাংলার জমিদাররা চেয়েছিল সেই লাভের ভাগিদার হতে। এখন একজন ব্যবসায়ী যদি যেকোনো মূল্যে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চায় তাহলে তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো পণ্য মজুদ করা। মূলত খাদ্যশস্য মজুদের ফলে তা জনগণের নাগালের বাইরে চলে। ফলে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ।
সংগ্রামী বাঙালি
বাঙালিরা কিন্তু আসলেই চুপ করে বসেছিল না যখন বিদেশী শাসনের শোষণের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ তাদেরকে নাজেহাল করে রেখেছিল। ফরাজী আন্দোলন, ফকির আন্দোলন ও তিতুমীরের আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিরা ওই বিদেশী শোষণের প্রতিউত্তর দেয়। এর মধ্যে তিতুমীরের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ ছিল সরাসরি নীল চাষের বিপক্ষে বাঙালির অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এসব আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পিছনে মূল কারণ ছিল বাংলার নবাব, জমিদার ও অন্যান্য অভিজাত দুর্বলতা ও অনাগ্রহ।
ব্রিটিশদের রাজনৈতিক কূটকৌশলে হতবুদ্ধ বাংলার নবাব ও অভিজাতবর্গ নিজেরাই নিজেদের পায়ে কুড়াল মারে। মুসলমানদের মধ্যে স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা বাংলায় তাদের পতন নিয়ে আসে। আর এই সুযোগে হিন্দু জমিদাররা বাংলার হর্তাকর্তা হওয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। হিন্দু জমিদারদের অর্থলোভ তাদের অন্য সব দোষকে ছাপিয়ে যায়। কারণ তারা মুসলিম শাসনের পতনের পর নিজেরা ক্ষমতা দখলের বদলে বাংলাকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়। এমনকি ব্রিটিশ বিরোধী ঐ সব আন্দোলনে তারা নিজেদের জাতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এহেন পরিস্থিতিতে ঐ সকল আন্দোলন সফল হওয়ার আশা করা যায় না।
উপনিবেশবাদী অভিজ্ঞ ব্রিটিশ
স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অর্থলোভ, নেতৃত্বশূন্যতা ও হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ সহ নানা বিষয় ব্রিটিশদের বাংলা দখলে সহায়তা করেছিল। তবে ব্রিটিশরা যখন বাংলা দখল করেছিল তখন তার আগেই তারা উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বিশাল অংশে নিজেদের উপনিবেশে স্থাপন করেছে। অর্থাৎ তারা ছিল সেই সময়ে উপনিবেশবাদের চ্যাম্পিয়ন। তারা উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বে স্থানীয়দের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে। এমনকি বলা যায় ঐ সময় ব্রিটিশরা বাঙালিদের সম্পর্কে যতটা জানতো বাঙালিরা নিজেদের সম্পর্কে এতটা জানতো না।
শেষকথা
বাংলায় যে এ দুটি দুর্ভিক্ষই ঘটেছিল তা নয়। তবে ঐতিহাসিকভাবে এই দুটির গুরুত্ব অত্যাধিক। আর অতীতের অভিশপ্ত ইতিহাস থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি, তবে অতীতের সেই অভিশাপ আমাদের উপর আবার আপতিত হবে।